করোনা ভাইরাসে মসজিদ বন্ধ নিয়ে মতামত

Spread the love

পৃথিবীতে প্লেগ, কলেরা, এইডস, নানা ধরণের ফ্লু মহামারি হিসেবে এসেছে সেই সৃষ্টির আদি থেকেই। কিন্তু এবারের করোনা ভাইরাস অতীত ইতিহাসকে নতুনভাবে ভাবাচ্ছে আমাদের। আমি গত ক’দিন ধরে খুঁজছিলাম কোথাও আমাদের পূর্বসূরিদের কেও মহামারি দেখা দিলে মসজিদ ও ইবাদাতখানা বন্ধ করেছিলেন কিনা। যদিও সায়্যিদুনা উমারের সময় প্লেগে পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজার সাহাবি ও তাবেঊন ইন্তেকাল করেন, কিন্তু তারা মসজিদ বন্ধ করেছিলেন এ মর্মে কোন দলিল আজো পাইনি। তবে কর্ডোভায় এক মহামারি মসজিদ বন্ধ ছিলো বলে ইমাম যাহাবি উল্লেখ করেছেন।

আরও পড়ুন >> সূরা ইখলাস ও সূরা কাহাফ পাঠের ফজিলতসমুহ

মহামারি ছড়িয়ে পড়ার সূচনা লগ্নেই আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা “হু” একে পেন্ডামিক আখ্যা দেয়ায় বিশ্ব নড়ে চড়ে ওঠে। এর পরামর্শ অনুযায়ি সারা দুনিয়ার ৮১ টা রাস্ট্র স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা সিদ্ধান্ত নিয়েই স্ব স্ব দেশে বিভিন্ন নির্দেশ নামা জারি করে দেয়। আর সত্যি বলতে কি আমরা যারা বিভিন্ন মসজিদ ও সেন্টার নিয়ে আছি আমরা আমাদেরকে ফতোয়া ও পদক্ষেপ গুলো সেই সিদ্ধান্তের আলোকেই করতে হয়েছে বা করতে হচ্ছে।

মজার কথা হলো, ইসলামের সবচেয়ে প্রকাশ্য মোজেযা হলো সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তাকে সোজাসুজি ভাবেও যেমন মেনে চলা যায়, অনুরূপভাবে খুব কঠিন সন্দিক্ষণেও তাকে সাথে নিয়ে জীবন পার করা যায়।

মহামারির ক্ষেত্রে ইতিহাস যেমন বলেনা যে মুসলিমগণ তাদের মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছিলো কোন এক মহামারিত। অনুরূপ ভাবে এখন বন্ধ করে দিলেও ইসলামি “মাক্বাসিদ শারীয়ার” সাথে সাংঘর্ষিক হবেনা, আলহামদু লিল্লাহ।

যাহোক, বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের মসজিদ ও মাদ্রাসা বা ইসলামি ইবাদাত পালনের যায়গা সমূহে করণীয় নিয়ে আমার চিন্তা হলো নিম্ন রূপঃ
১- করোনা ভাইরাস চীনের তৈরি হোক, আমেরিকার বানানো হোক, কিংবা মহাবিশ্বের অন্য কোন সৌর মন্ডলের থেকে আসা কিছু হোক, আমি মনে করি করোনা ভাইরাস একটা মারাত্মক ক্ষতিকর ভাইরাস। যা ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বের বড় ধরণের ক্ষতি হয়েছে। অর্থনৈতিক ভাবে সারা পৃথিবী ধাক্কা খেয়েছে, রাজনীতিও মুখ থুবড়ে পড়েছে, সামাজিক সংস্কার বা রীতিনীতিতে এসেছে মারাত্মক পরিবর্তন।
সবচেয়ে ভয়ংকর হয়েছে ধর্মীয় বিধিবিধান পরিচালনায়। সত্যি বলতে কি, এ ক্ষেত্রে মুসলিমরা বেশ নেতিবাচক স্থানে পড়ে গেছেন। আমাদের সবার মাথায় একটা জিনিষই ঢুকানো দরকার ছিলো, আর তা হলো এটা আল্লাহর একটা বড় পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় আমরা মুসলিমদেরই প্রমান করতে হবে আমরা বেশি ঐক্যবদ্ধ চিন্তাধারার জাতি, আমরা এক আল্লাহর প্রশান্ত আত্মার গোলাম, এবং আল্লাহর তাক্বদীরে এমন বিশ্বাসি যে বিশ্ব বিস্ময়াভিভূত হয় আমাদের ঈমান ও ঈমানময় কার্যক্রম দেখে।

আরও পড়ুন >>  ১০০/- টাকার প্রাইজবন্ড ড্র ।। Prize Bonds Result

২- ইসলামের ইতিহাস চলে আসছে হাজার হাজার বছরের দীর্ঘ সময় ও নানান সমস্যা নিয়ে। মহামারি হলে ধর্ম ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের যায়গাগুলো ছিলো মহামারি-কাতর মানবতার রক্ষার জন্য। এইবারেই প্রথম দেখা যাচ্ছে যে, আমরা ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা অন্যান্য জাতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছি বেশি। সাথে সাথে আমাদের রাজা বাদশাহ ও রাস্ট্রপ্রধানরা অতি সেক্যুলারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে মুসলিমদের স্বকীয় ধর্মীয় চিন্তা দূর্বল হয়ে ধরা দিয়েছে। আমেরিকা যেদিন তাদের স্কুল বা লোক সমাগম বন্ধ করলো, ঐ দিনেই বা তার এক আধটা দিন আগেই আরব দেশ গুলোর মসজিদ সমূহে করুণ স্বরে মুয়াযযিনের কণ্ঠে শোনা গেলোঃ সাল্লু ফী বুয়ুতিকুম, মানে সালাত সবাই বাড়িতেই পড়। এই ভাবে মুসলিম বিশ্বে এক সর্বগ্রাসী “ওহান” বা দূর্বলতা ছেয়ে পড়ে। সবাই আরবদের মত মসজিদ মাদ্রাসা, স্কুল ইত্যাদি বন্ধের দ্বার প্রান্তে এগিয়ে গেলো। এবং গোটা উম্মাহ এখন সেই দিকেই মোড় নিয়েছে। ব্যাপারটা এমন যে এই ক্ষেত্রে আমরা রাস্ট্রব্যবস্থার অধীনে থেকে আনুগত্য পোষণ করার দিকেই গেছি।

৩- যেহেতু মুসলিম রাস্ট্রপ্রধানরা তাদের আন্তর্জাতিক সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ও দিচ্ছেন। অন্য দিকে তার থেকে আলো নিয়ে অমুসলিম দেশে থাকা মুসলিমরা তাদের নিজস্ব চিন্তায় “সরকার ব্যবস্থার” অনুগামী হচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে। কাজেই “লা তাজতামিউ উম্মাতি আলা দ্বালালাহ” বা আমার উম্মাহ বিভ্রান্তির উপর ঐক্যবদ্ধ হবেনা। এই হাদীসের আলোকে উম্মাতের যে কোন সিদ্ধান্তে আমরা একমত হই। যে যে রাস্ট্রে আছি তাদের দেয়া নির্দেশিকা মেনে আমাদের ধর্মীয় স্থান, ও ধর্মীয় কর্ম ক্ষেত্রের আইনগুলো মেনে চলি। যেমনঃ

ক) মসজিদ ও মাদ্রাসা বন্ধ করার সরকারি ভাবে প্রজ্ঞাপন এলে বন্ধ করে দেই। যেহেতু এটা সরকারের নির্দেশ ও জনস্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে নেয়া সিদ্ধান্ত, কাজেই তা মেনে চলতে কোন শর’ঈ সমস্যা নেই। এই সম্পর্কে আলআযহারের ফাতওয়া, সাঊদী হাইয়াতু কিবারিল উলামা এর ফাতওয়া এবং ইউরোপীয়ান উলামা কাউন্সিল সহ সারা বিশ্বের উলামাদের ফাতওয়া এর ই পক্ষে। কাজেই আমরা অতিরিক্ত আবেগ দেখিয়ে সাধারণ মুসলিমের ঈমানের পরীক্ষা না নেই।

খ) মসজিদ গুলো বন্ধ না হলেও স্কলারদের পক্ষ থেকে কিছু ডিরেকশান এসেছে। যেমনঃ সুন্নাহ সালাহ বাসা থেকে পড়ে আসা, অথবা ঘরে যেয়ে পড়া। আসার সময় অজু ঘর থেকে করে আসা। শুধু মাত্র ফরদ্ব সালাহ আদায় করে ঘরে ফিরে যাওয়া, বেশিক্ষণ মসজিদে এক সাথে না থাকা, ইমামগণ সালাতে তিলাওয়াহ সংক্ষিপ্ত করা, খুৎবাহর কথা কমিয়ে আনা, মসজিদে সালাহ ছাড়া অন্যান্য কর্মকান্ড সাময়িক বন্ধ রাখা। এগুলো মানতে শরীয়াতে কোন নিষেধ নেই।

গ) যদিও মসজিদ বন্ধ না করাই হলো ইসলামের মৌলিক শিক্ষা, কিন্তু বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হলে তাও অনিসলামিক নয়। কাজেই এখানে আমরা দুই তিন ভাগে বিভক্ত না হয়ে পড়ি। মুসলিম বিশ্বে এই ধরণের দুই তিন ভাগে বিভক্ত হলে তেমন ক্ষতি হয় কিনা তা ভাবছিনা। ভাবছি আমরা যারা অমুসলিম দেশে থাকি তারা দুই তিন ভাগে বিভক্ত হলে ইসলামকেই হাসির খোরাক বানিয়ে ফেলবো। আজকে আমাকে এক ভাই আমাদের শায়খ তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহের এক ভিডিও দেখালেন, তাতে তিনি মসজিদ বন্ধের কথাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন না। এটা কিন্তু ইউকের ফাতওয়া নয়। ইউকেকে পাকিস্তানের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে। আমার মনে হয় মুসলিমদের এক থাকা ও ঐক্যবদ্ধ ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ।

৪- করোনা ভাইরাস বৃদ্ধির সময় সমবেত হয়ে কোন ইবাদাতের চেয়ে ব্যক্তিগত ইবাদাত বাড়ানো দরকার। আমওয়াস এর মহামারির ভাইরাসে আক্রান্ত সাহাবী ও তাবেঈগণের মরণের সময় যেসব বাণীগুলো ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে, তা পড়লে দেখা যায় মহামারিতে মৃত সাহাবা ও তাবিঊন বুঝতে পেরেছিলেন তারা শাহাদাতের মর্যাদা পেতে যাচ্ছেন। আমাদের ও প্রতিটা মূহুর্তে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতির চিন্তা থাকা উচিৎ। কুরআন তিলাওয়াত, সূরা ইয়াসিন সূরা রহমান, সূরা মুলক, সূরা কাহাফ, সূরা বাক্বারার শেষের আয়াত দুইটা, ৩০ তম পারাহ ইত্যাদি মুখস্ততে মন লাগানো দরকার। ইমাম নাওয়ায়ির ৪০ হাদিসগুলো মুখস্ত করার একটা ভালো সময় ও মৌসুম এইটা। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় আমাদের পাশের গ্রামের ডাক্তার অমল হিন্দু হয়েও অনেক সূরা মুখস্ত করেছিলেন। আমরা আল্লাহর বান্দাহ হিসেবে পরিচয় দিতে কুরআনের সাথে কয়দিন ভালো বন্ধুত্ব করতে পারি।

তাহাজ্জুদ সালাতটা নবী (সা) এর মত একটু আদায় করার চিন্তা করি। মসজিদে যেতে পারছিনা বলে অনেক কষ্ট লাগছে। দেখবেন তাহাজ্জুদে লম্বা তিলাওয়াত করলে হাও মাও করে কান্না এলে, বুক ভরা দরদে আল্লাহকে ডাকলে মন অনেক ভালো হয়ে যাবে। আর নোংরামি থেকে ফিরে আসি, দেখবেন মন জান্নাতের সুরভী নিতে ছটফট করছে।

৫- করোনা সহ মহামারিতে আমাদের নবী (সা) এর বেশ কিছু দুয়া আছে। ঐগুলো সর্বত্রই এখন পাওয়া যাচ্ছে। বারবার পড়ি ঐ গুলো। তবে সারা দিন ১০০ বার ইস্তেগফার করার মত আমল গুলো বাড়াই। বিশেষ করে সকাল সন্ধ্যায় সাইয়িদুল ইস্তেগফারটা মোটেই যেন না ভুলি।

৬- দুয়া মুমিনের শক্তিশালী অস্ত্র। একে কাজে লাগাই। একে অন্যের জন্য দুয়া করি। তাতে ফিরিশ্তা ও আমাদের সাথে দুয়ায় শরিক হয়ে যাবে। আমি দুয়া করলে ফিরিশতা ঐ ভায়ের পক্ষ হয়ে আমার জন্য দুয়া করবেন। আসুন এই অন্তিম সময়ে একে অপরের প্রতি ভালোবাসার জানালাটা প্রতিটি অন্তর থেকে খুলে দেই।

৭- মহামারিতে ভীত হওয়া, বা ভয় ছড়ানো ভালো ঈমানের লক্ষণ নয়। একে কেন্দ্র করে মিথ্যার বেসাতি বিলানো আরো ভয়াবহ। আলিম উলামার উপর কর্তব্য একে ট্যাকল করতে যেয়ে মানুষকে আল্লাহ মুখী করা ফেলা। কা’বাহ নিয়ে যেভাবে মানুষকে সাঊদি বিরোধি করা হচ্ছে, বাংলাদেশের অপ্রতুলতার জন্য যেভাবে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে, আরবদের বিরুদ্ধে মসজিদ বন্ধের কারণে যেভাবে ট্রল করে তুচ্ছ ও তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে এই সব গুলো উম্মাতের সুস্থতার লক্ষণ নয়। মহামারিতে আমিও হতে পারি মৃত ব্যক্তিদের একজন। আমার মুখ, আমার বুক, আমার মাথার গ্রন্থির নানা কম্পার্ট্মেন্ট, ও আমার হৃদয়ের কন্দরে কন্দরে ইসলাম ও মুসলিমের জন্য ফুলের বসন্ত ফুটাই, ঘৃণার বীজ নয়, অহংকারের আগুন নয়, নয় মানুষকে ছোট করার বিবমীষাময় বক্তব্য।

আল্লাহ আমাদের ভালো রাখুন। দুয়া করি, দুয়া চাই।

সংগ্রহঃ Dr M Abdus Salam Azadi

Check Also

পবিত্র রমজানে

পবিত্র রমজানে আল্লাহর নৈকট্য লাভের 10 আমল

Spread the loveপবিত্র রমজানে আল্লাহর নৈকট্য ও পুণ্য লাভের সর্বোত্তম সময়। কেননা রমজান মাসে আল্লাহ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *