লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা – ধান, নদী ও খালের জন্য বিখ্যাত বরিশাল। সেই বরিশালে যাওয়ার একটি সুযােগ পেয়ে গেলাম। তাও আবার লঞ্চে! ছােটো খালার শ্বশুরবাড়ি বরিশালে। গত মাসে যখন তাঁরা সপরিবার সেখানে যাচ্ছিলেন, আমাকেও যাওয়ার জন্য প্রস্তাব করলেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
কারণ, বাসে, ট্রেনে, এমনকি নৌকায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে; কিন্তু লঞ্চে ভ্রমণের সুযােগ হয়নি। খালাতাে ভাই রাজীবের মুখে লঞ্চ ভ্রমণের মজার। মজার অনেক কথা শুনেছি। তাই আমি রাজি হতে মােটেও দেরি করিনি। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আমরা সদরঘাটে পৌঁছলাম। ঘাটের টিকিট কিনে প্রবেশ করলাম জেটিতে। দেখলাম প্রকাণ্ড সব লঞ্চ জেটির সঙ্গে বাঁধা।
দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ মিটার। বেশ কৌতুহল নিয়ে লঞ্চটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দোতলা ও তিন তলায় সারবাধা বিলাসবহুল কক্ষ। নিচতলার পুরােটাই ডেক। নিচতলার ডেকের মেঝেতে যাত্রীরা চাদর বিছিয়ে নিজের শােয়ার ব্যবস্থা করছে। লঞ্চের পিছন দিকে ইঞ্জিনরুম, রেস্তোরা ও একটি চায়ের দোকান। জানা গেল জরুরি চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টহল দিচ্ছে আনসার সদস্যরা। রাত ৯টার দিকে লঞ্চ বরিশালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। যদিও লঞ্চ ছাড়ার সময় ছিল সাড়ে আটটা। ঃঃ লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাঃঃ
আরও পড়ুন >> ভাব-সম্প্রসারণ কাকে বলে? লেখার নিয়ম উদাহরণসহ
ধীরে ধীরে জেটির মানুষগুলাে ছােটো হতে হতে ঝাপসা হয়ে গেল। আমরা ঘাট থেকে অনেক দূরে চলে এলাম। লঞ্চের সারেং একটু পরপর সাইরেন বাজাচ্ছেন আর সার্চলাইট ফেলে পথটা দেখে নিচ্ছেন। অনেকক্ষণ চলার পর একটি বড়াে নদী দেখতে পেলাম। তীর দেখা যায় না। নদীটির নাম শুনলাম মেঘনা। এটি বাংলাদেশের গভীরতম ও প্রশস্ততম নদী। রেলিং ধরে দাঁড়ালে যতদূর চোখ যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছােটো ছােটো আলােকবিন্দু চোখে পড়ে। খালা জানালেন ওগুলাে মাছধরা নৌকা। নৌকাগুলাে দেখে ‘পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পরপর একটি দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভটভট আওয়াজ তুলে উল্টো দিকে যাচ্ছে কিংবা আমাদের লঞ্চ সেগুলােকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। আকাশের তারকারাজি আর নদীতে ভেসে থাকা আলােকবিন্দুগুলাে অপরূপ দৃশ্য তৈরি করেছে। (লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা)
একসময় রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেল। লঞ্চে রান্না করে ইলিশ মাছ ভাজা আর ডাল দিয়ে রাতের খাওয়া সারলাম। খাওয়া শেষে বসলাম কেবিনের সামনে চেয়ারে। সবাই মিলে রাতের নীরব সৌন্দর্য উপভােগ করছি আর গল্প করছি। ঘড়িতে তখন রাত এগারােটা। যাত্রীদের কেউ কেউ শুয়ে পড়েছে আবার কেউ কেউ আড্ডা দিচ্ছে। ডেকে হকার তেমন দেখা যাচ্ছিল না।
খালামণি বরিশালের বিখ্যাত ব্যক্তিদের গল্প শােনাচ্ছেন। রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী অশ্বিনীকুমার দত্ত, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর, মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা বিজয় গুপ্ত, কুসুমকুমারী দাশ ও তাঁর পুত্র জীবনানন্দ দাশ, সুফিয়া কামাল, কামিনী রায়, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে’ গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী এবং গানটির সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ আরাে অনেকের কথা জানলাম যারা এই বরিশালেরই মানুষ। (লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা)
বাংলা কবিতা >> প্রেমজীবন এবং আহা! জীবন – আশিকুজ্জামান জুয়েল
প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের শহরে যাচ্ছি ভেবে রােমাঞ্চ অনুভব করলাম। হঠাৎ নৌপুলিশের একটি স্পিডবোেট গতি কমিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেল। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও অবৈধ মালামাল পরিবহণ রােধে এই অন্ধকার রাতেও তারা টহল দিচ্ছে। দূরে আরাে কয়েকটি লঞ্চ দেখা যাচ্ছে। সারেং মাঝে মাঝে সাইরেন বাজাচ্ছে। একটু পরপরই সার্চলাইট ফেলে পথ দেখে নিচ্ছে। সারেঙের কক্ষে গিয়ে দেখলাম কত রকমের প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করছে – রাডার, কম্পাস, জিপিএস ইত্যাদি। (লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা)
হয়তাে প্রথমবার লঞ্চে চড়ছি বলে উত্তেজনায় ঘুম আসছিল না। তবুও খালামণির কথায় শুয়ে পড়লাম। ভোের পাঁচটার দিকে খালামণি ডেকে তুললেন – “এই তােরা ওঠ! আমরা বরিশালে পৌঁছে গিয়েছি।’ হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম। দেখলাম ঘাটে আরাে কয়েকটি লঞ্চ বাধা। যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে। ভিড় কমলে আমরাও ব্যাগগুলাে নিয়ে নেমে পড়লাম। গত রাতটি আমার জীবনের স্মরণীয় একটি রাত হয়ে থাকবে। অসাধারণ একটি ভ্রমণের ভালাে-লাগা নিয়ে আমরা পা ফেললাম জীবনানন্দের শহরে।। (লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা)