সূরা আল ফাতেহা বাংলা অর্থসহ শানে নুযূল – surah fatiha bangla অর্থ যা দিয়ে খোলা হয় বা শুরু করা হয়। কুরআন মাজীদে প্রথম সূরা হিসেবে এর এ নাম রাখা হয়েছে। এ সূরা দিয়েই কুরআন শুরু করা হয়েছে। সাধারণত সূরার কোনো একটি শব্দের ভিত্তিতে প্রায় সব সূরারই নামকরণ করা হলেও একমাত্র দুটো সূরার নাম এমন শব্দে রাখা হয়েছে, যা ঐ সূরায় নেই। একটি সূরা ফাতিহা, আরেকটি সূরা ইখলাস।
সূরা আল ফাতেহা নাযিলের সময়
নবুওয়াতের প্রথমদিকেই এ সূরাটি নাযিল হয়। পরিপূর্ণ সূরা হিসেবে এ সূরাই প্রথম নাযিল হয়েছে। এর আগে সূরা আলাক, মুয্যাম্মিল ও মুদ্দাসিরের প্রথম কয়েকটি আয়াত নাযিল হলেও সূরা ফাতিহার পূর্বে আর কোনো পূর্ণ সূরা নাযিল হয়নি ।
সূরা আল ফাতেহা আলোচ্য বিষয়
এ সূরা এমন এক দোয়া, যা কুরআন তিলাওয়াত শুরু করার সময় পড়া উচিত
নাযিলের পরিবেশ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমাজে জন্ম নিয়েছিলেন সেখানে যত মন্দ রীতি-নীতি ও কাজ-কর্ম চালু ছিল, তা তিনি পছন্দ করতেন না। তাই ছোট বয়স থেকেই অন্য সবার চেয়ে তাঁর স্বভাব-চরিত্র ও চাল-চলন আলাদা ধরনের ছিল। আল্লাহ তাআলা যেহেতু সব মানুষকেই কোন্টা ভালো আর কোন্টা মন্দ, তা মোটামুটি বোঝার তাওফীক দিয়েছেন, সেহেতু মক্কাবাসীরা যত খারাপ কাজই করুক, তারা রাসূল (স)-এর চরিত্রের প্রশংসা করত ।
যে বয়সে মানুষ ভালো-মন্দ বুঝতে পারে সে বয়স থেকেই তিনি সমাজে যা কিছু খারাপ দেখতেন, তা অপছন্দ করতেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর পবিত্র মন সমস্ত মন্দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তাই তরুণ বয়সেই তিনি সমবয়সীদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুযূল” নামক একটি সমিতিতে শরীক
১. ‘হিলফুল ফুযূল’ সমিতির মাধ্যমে যুবক বয়সেই মুহাম্মদ (স)-এর মধ্যে সমাজ সেবার মনোভাব বিকাশ লাভ করে। তাই রাসূল (স)-এর জীবনে এ সমিতির গুরুত্ব যথেষ্ট।
এ সমিতির ইতিহাস ও নামকরণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা দরকার। এ সমিতিটি রাসূল (স) গঠন করেননি। সমিতিটি আগেই গঠিত হয়েছিল। এতে রাসূল (স) যোগদান করার পর এর গঠনমূলক কাজের প্রকাশ হয় এবং সমিতির জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় ।
ফাদল ইবনে ফুদালা, ফাদল ইবনে বিদায়াহ, ফুদাইল ইবনে হারিস, ফুদাইল ইবনে শারায়াহ, ফাদল ইবনে কুযায়াহ এ সমিতি গঠন করেন। তাদের প্রত্যেকের নামই ফাদল বা ফুদাইল ছিল। এর মূল শব্দ ‘ফাদল’ এবং এর বহুবচন ‘ফুল’। এরা সমাজ সেবার উদ্দেশ্যে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। আরবীতে চুক্তিকে ‘হিলফ’ বলা হয়। সুতরাং ‘হিলফুল ফুযূল’ মানে হলো ফাদল নামধারী কয়েকজনের চুক্তি।
বিস্তারিত জানতে Google News অনুসরণ করুন
সূরা আল ফাতেহা হয়ে সমাজসেবার কাজ শুরু করেন। বিধবা ও ইয়াতীমকে সাহায্য করা, ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে দেওয়া, যুলুম করা থেকে ফিরিয়ে রাখা, আমানত রক্ষা করা, সত্য কথা বলা এবং এ জাতীয় অনেক কাজ তিনি ঐ সমিতির মাধ্যমে করতে থাকলেন। এসব কাজের ফলে সবাই তাঁকে ‘আস সাদিক’ ও ‘আল আমীন’ অর্থাৎ একমাত্র সত্যবাদী ও একমাত্র আমানতদার বলে প্রশংসা করতে লাগল। সমাজকে ভালো করার এবং সমাজের মন্দ দূর করার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি কয়েকটি কথা বুঝতে পারলেন :
১. সমাজের অসৎ নেতা, কর্তা, ধনী ও প্রভাবশালীদের মন্দ চরিত্রের কারণেই সমাজে এত খারাবী চালু আছে।
২. তাদের অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও যুলুমের ফলেই সমাজে এত অশাস্তি ও দুঃখ দেখা যায়।
৩. সাধারণ মানুষ যালিম নেতাদের তৈরি আইন ও নিয়ম-কানুনে এমনভাবে বাধা যে, এসব মুসীবত থেকে মুক্তির কোনো পথই তারা পাচ্ছে না।
এসব কথা রাসূল (স)-এর দরদি মনকে পেরেশান করতে লাগল। কী করে সমাজকে সংশোধন করা | যায় এবং কীভাবে মানুষের অশান্তি ও দুঃখ দূর করা যায়, এ চিন্তা তাঁকে অস্থির করে তুলল। অনেক | সময় তিনি একা একা কোনো নিরিবিলি জায়গায় এসব নিয়ে চিন্তা করতেন, নীরবে আল্লাহকে | ডাকতেন এবং দোয়া করতেন। এতে তাঁর চিন্তা ও পেরেশানি আরও বেড়ে গেল। শেষদিকে তিনি মক্কার বাইরে মিনার নিকটে একটি উঁচু পাহাড়ের উপরের এক গুহায় বসে ভাবতেন আর আল্লাহর দরবারে ধরনা দিতেন ।
যে পাহাড়ের গুহায় তিনি বসতেন, তা পাথরের তৈরি এবং গুহাটিতে ঢোকার পথটুকু সরু। গুহার চারপাশই পাথরে ঘেরা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, গুহার ভেতরে বসলে সামনে কয়েক ইঞ্চি জায়গা এতটুকু ফাঁকা আছে যে, সেখান থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত কা’বাঘর স্পষ্ট দেখা যায়। অবশ্য আজকাল কা’বা শরীফের চারপাশের উঁচু দালানের জন্য ঐ গুহা থেকে কা’বাঘর চোখে পড়ে না; কিন্তু কা’বার চারপাশের বায়তুল হারামের মসজিদ ও মিনার দেখা যায়।
এ গুহাটিকেই ‘হেরা গুহা’ বলে, আর পাহাড়টিকে ‘জাবালুন নূর’ বা ‘আলোর পাহাড়’ বলা হয়। কিছুদিন রাসূল (স) এভাবে আল্লাহর দরবারে ধরনা দিতে থাকলেন। মাঝে মধ্যে একসাথে কয়েক দিন গুহাতেই কাটাতেন এবং হযরত খাদীজা (রা) খাবার ও পানি দিয়ে যেতেন। ক্রমে ক্রমে গুহায় একটানা থাকার সময়টা আরও লম্বা হতে লাগল। যতই দিন যায়, রাসূল (স)-এর দরদি মনের অস্থিরতা আরও বেড়ে চলে।
দীর্ঘ কয়েক মাস বৃষ্টি না হওয়া চৈত্র মাসে যেমন পিপাসায় মাঠ ফেটে গিয়ে বৃষ্টির পানির জন্য হা- হুতাশ করতে থাকে, মানবসমাজের অশাস্তি কীভাবে দূর করা যায় সে চিন্তায় রাসূল (স)-এর | অনুভূতিশীল মন তেমনি কাতরভাবে আল্লাহর কাছে পথের দিশা চাইতে লাগল ।
এমন অবস্থা ও পরিবেশেই সর্বপ্রথম জিবরাঈল (আ) চৈত্র মাসের আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির মতো ওহী নিয়ে হাজির হন। সূরা ‘আলাক’-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত হেরা গুহায়ই নাযিল হয়। হঠাৎ এত বড় ঘটনায় রাসূল (স) ঘাবড়ে যান। তবুও কিন্তু বেশ কিছুদিন ওহী না আসায় তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। – তখন সূরা মুদ্দাসির-এর প্রথম সাতটি আয়াতে তাঁকে রাসূল হিসেবে প্রাথমিক দায়িত্ব দেওয়া হয় ৷
আরও পড়ুন >> বাকী এবং কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয় ইসলামে জায়েজ কিনা?
সূরা আল ফাতেহা এর কিছুদিন পরে সূরা মুয্যাম্মিল’-এর প্রথম কয়েকটি আয়াতে তাঁকে শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার হেদায়াত দেওয়া হয়।
এভাবে কয়েক কিস্তি কয়েকটি সূরার অংশ নাযিলের পর রাসূল (স) যখন ওহীর সাথে পরিচিত হলেন, জিবরাঈল (আ)-এর কয়েকবার আগমনে মনের প্রাথমিক ভয় ও বিব্রত ভাব যখন দূর হয়ে গেল এবং নবুওয়াতের মহান ও বিরাট দায়িত্ব যখন ঠিকভাবে বুঝে নিলেন তখনই পরিপূর্ণ সূরা হিসেবে সূরা ফাতিহা প্রথম এক পসলা বৃষ্টির মতো নাযিল হয়। সমাজের দুরবস্থা ও মানুষের অশান্তি দূর করার যে ঔষধ তিনি এতদিন অস্থিরভাবে তালাশ করছিলেন, সে আকাঙ্ক্ষিত জিনিসের খোঁজ তিনি এ সূরাটিতে পেয়ে গেলেন।
আলোচনার ধারাবাহিকতা (সূরা আল ফাতেহা)
মানুষ স্বাভাবিকভাবে ঐ জিনিসের জন্যই দোয়া করে, যার অভাব সে বোধ করে এবং যার কামনা- বাসনা তার দিলে আছে। আর তাঁর কাছেই সে দোয়া করে, যাঁর সম্পর্কে সে মনে করে যে, তিনি ঐ জিনিসটি দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কুরআনের শুরুতে এ দোয়া শেখানোর মাধ্যমে মানুষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন সঠিক পথ পাওয়ার উদ্দেশ্যে সত্য তালাশের মনোভাব নিয়েই এ কিতাবখানা পড়ে এবং নির্ভুল জ্ঞানের উৎস যে একমাত্র আল্লাহ— এ কথা খেয়াল করে তাঁরই কাছে | পথ দেখানোর দরখাস্ত করে যেন এ কিতাবখানা পড়া শুরু করে।
এটুকু বোঝার পর এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সূরা ফাতিহা ও বাকি কুরআন মাজীদের সম্পর্ক কোনো বই এবং এর ভূমিকার মতো নয়; বরং এ সম্পর্ক হলো দোয়া ও দোয়ার জবাবের মতো। সূরা ফাতিহা বান্দাহর পক্ষ থেকে একটি দোয়া আর গোটা কুরআন মাজীদ আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐ দোয়ার জবাব। বান্দাহ দোয়া করছে, ‘হে প্রভু! আমাদেরকে সঠিক পথ দেখাও।’ এর জবাবে মনিব গোটা কুরআন বান্দাহর সামনে রেখে দিয়ে যেন বলছেন, ‘তোমরা যে হেদায়াত ও পথপ্রদর্শনের জন্য আমার কাছে দরখাস্ত করেছ, এ কুরআনই সেই হেদায়াত ও পথ ।’
সূরা আল ফাতেহা সম্পর্কে আরও কতক জরুরি কথা
১. সূরা ফাতিহা শুধু একটি সাধারণ দোয়া নয়, শ্রেষ্ঠতম দোয়া। মানুষের সব চাওয়ার বড় চাওয়াই এখানে শেখানো হয়েছে। সিরাতুল মুস্তাকীম’ই মানুষের পার্থিব লক্ষ্যবিন্দু। এ পথে চলা মানে আল্লাহর নিয়ামতের মাঝে ডুবে থাকা এবং আল্লাহর গযব ও গোমরাহী থেকে বেঁচে থাকা। কুরআন ও হাদীসে যত দোয়া শেখানো হয়েছে সবই সূরা ফাতিহার ব্যাখ্যা। এ সূরাটি এমন একটি সামগ্রিক দোয়া, যা দ্বারা এতে একসাথে সবকিছু চাওয়া হয়েছে।
২. ‘দোয়া’ ও ‘চাওয়া’ বললে তিনটি কথা বোঝা যায় :
ক. কারো কাছে দোয়া করা হচ্ছে বা চাওয়া হচ্ছে।
খ. কেউ দোয়া করছে বা চাচ্ছে।
গ. দোয়াপ্রার্থী কোনো কিছু চাচ্ছে।
সূরা ফাতিহায় আসলে এ তিনটি কথাই আছে। প্রথম তিন আয়াতে শেখানো হয়েছে, ‘কার কাছে চাইতে হবে’। এর পরের আয়াতটিতে জানানো হয়েছে, যারা দোয়া করবে, তাদের মধ্যে কী কী গুণ থাকতে হবে, মানে কারা চাইলে পাবে। বাকি আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, কোন সূরা ফাতিহা জিনিস চাইতে হবে। মোটকথা, কার কাছে চাইতে হবে, কারা চাইলে পাবে এবং কী চাইতে হবে- এ তিনটি কথাই মানবজাতিকে এ সূরায় শেখানো হয়েছে।
More Product >> Apple 10.2-inch iPad 2023 Space Grey
৩. রাসূল (স) এ সূরায় কী শিক্ষা পেলেন
(ক) প্রথম কয়েকটি আয়াতে রাসূল (স)-কে বলা হয়েছে, “হে রাসূল! আপনি সমাজের কল্যাণ ও মানুষের সুখ-শান্তির জন্য পেরেশান হয়ে যে পথ তালাশ করছেন, তা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। সে পথ একমাত্র তিনিই দেখাতে পারেন, যিনি সমস্ত সৃষ্টির ‘রব’ হিসেবে সবার অভাব পূরণ করেন, যিনি সবচেয়ে দয়াময় এবং যিনি শেষ বিচারের দিনেরও মালিক।
যিনি গোটা সৃষ্টির অভাব পূরণ করেন, মানবজাতির হেদায়াতের অভাবও শুধু তিনিই পূরণ করতে পারেন। আর শুধু দুনিয়ার দুঃখ দূর করার চিন্তা করলেই মানুষের চলবে না, মরণের পরও যাতে মানুষ সুখ পায়, সে ভাবনাও থাকতে হবে। তাই যিনি দুনিয়া ও আখিরাতের মালিক, তিনিই সত্যিকার শান্তির পথ দেখানোর যোগ্য, অন্য কেউ নয়।
হে রাসূল! আপনি সেই মহান রবের কাছেই ঐ পথ পাবেন, যে পথ এতদিন আপনি হয়রান হয়ে তালাশ করেছেন। তাঁরই নাম আল্লাহ এবং সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য। যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর, যার মধ্যে যত গুণ এসব তো আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন, তাই সকল প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য। গুণ, সৌন্দর্য ও কল্যাণ সৃষ্টিজগতে যার যার মাঝে দেখা যায় তারা কেউ এসব সৃষ্টি করেননি । তাই প্রশংসার বাহাদুরি তাদের পাওনা হতে পারে না। সুন্দর মানুষ, মিষ্টি ফল, বিরাট সূর্য ইত্যাদি যিনি সৃষ্টি করেছেন, বাহাদুরি একমাত্র তাঁরই। তাই প্রশংসার মতো যা-ই পাওয়া যায় একমাত্র ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলাই সবার কর্তব্য ।
(খ) ‘আমরা শুধু তোমারই দাসত্ব করি ও তোমার কাছেই সাহায্য চাই’— এ আয়াতটিতে বলা হয়েছে, ‘হে রাসূল! যে জিনিস আপনি চাচ্ছেন, তা পেতে হলে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হবে। সমাজ সংশোধন ও মানুষের কল্যাণসাধন এমন কঠিন কাজ, যা একা একা করার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাকে এমন একদল লোক জোগাড় করতে হবে, যারা আপনার সাথে মিলে আমার দাসত্ব করবে এবং আমার সাহায্য চাইবে।’
এ আয়াতটিতে এজন্যই বহুবচনের পদ ‘আমরা’ ব্যবহার করা হয়েছে। জামাআতবদ্ধভাবে সুসংগঠিত চেষ্টা ছাড়া সমাজের কল্যাণসাধন অসম্ভব। পরোক্ষভাবে এ আয়াতে এটাকেই প্রথম শর্ত বানানো হয়েছে। কারণ, এ কাজ একা করা সম্ভব নয়।
দুই নম্বর শর্ত হলো, মানবসমাজের হেদায়াত ও শান্তি যারা চায়, তাদেরকে পূর্ণ তাওহীদবাদী হতে হবে। একমাত্র আল্লাহর দাসত্বই তাদের জীবনধারা হতে হবে। আল্লাহর হুকুম ও মর্জির বিপরীত অন্য কোনো শক্তির যারা পরওয়া করে, তারা এ কঠিন পথে চলার যোগ্য নয় ।
তিন নম্বর শর্ত হলো, যারা এ পথের পথিক, তারা সব ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চায়; তারা অন্য কারো মুখাপেক্ষী হয় না। তারা অন্য কারো দয়া ও সহায়তার ধার ধারে না। সারা দুনিয়া তাদের বিরোধী হলেও একমাত্র আল্লাহর সাহায্যের উপর ভরসা করে তারা আল্লাহর দেখানো পথে মানবসমাজকে সংশোধন করার চেষ্টা করে।
এটাই হচ্ছে “ইকামাতে দীন-এর পথ। এরই অন্য নাম আল্লাহর পথে জিহাদ। বাংলাভাষায় সূরা ফাতিহা একেই বলা হয় “ইসলামী আন্দোলন’। তাই আন্দোলনের শুরুতেই রাসূল (স)-কে এসব শর্ত এ সূরাটিতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
(গ) শেষ কয়েকটি আয়াতে রাসূল (স)-কে অনেক মূল্যবান কথা শেখানো হয়েছে- আল্লাহর কাছে ঐ পথই চাইতে হবে, যা সরল ও মযবুত। দুটো বিন্দুর মাঝখানে সরল রেখা একটাই হবে; কিন্তু বাঁকা রেখা অনেক হতে পারে। যেটা যত বাঁকা, সে রেখাটা ততই লম্বা। অশান্তি থেকে শান্তি পর্যন্ত যে সোজা পথ, তাও একটাই। আর বাঁকা পথের কোনো সীমা-সংখ্যা নেই । তাই একমাত্র ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ই চাইতে হবে ।
এ আয়াতগুলোতে আরও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর মেহেরবানী ও নিয়ামত পাওয়া এবং আল্লাহর গযব ও গুমরাহী থেকে বেঁচে থাকার নিয়তেই ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ চাইতে হবে।
এ আয়াতগুলোতে পরোক্ষভাবে আরও একটি কথা শেখানো হয়েছে যে, হে রাসূল! কোন্ পথটা সিরাতুল মুস্তাকীম, তা আপনি নিজে বাছাই করবেন না। কারণ, বাছাই করতে আপনার ভুল হতে পারে। আপনার তো নিয়ামত দরকার এবং গযব ও গুমরাহী থেকে বাঁচা প্রয়োজন। তাই নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর নিকট সমর্পণ করুন। যে পথ তিনি দেখাবেন, সে পথেই চলুন। আপনার নিজস্ব মত, রুচি ও খেয়ালের দ্বারা সে পথ বাছাই না করে ঐ পথকেই ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ মনে করবেন, যে পথ কুরআনে দেখানো হচ্ছে।
আরও পড়ুন >> আপনার স্মার্টফোন কিভাবে দ্রুত চার্জ করবেন
সূরা আল ফাতেহা গুরুত্ব
১. আল্লাহর সাথে বান্দাহর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সেতুবন্ধন হলো এ সূরা। বান্দাহ তার মনিবেরই শেখানো দোয়ার মাধ্যমে তাঁর নিকট ধরনা দেওয়ার এক মহাসুযোগ পেয়েছে। এ যেন সরকারিভাবে দেওয়া দরখাস্তের ফরমে দস্তখত করার সুযোগ। যিনি দরখাস্ত কবুল করবেন তিনিই যদি দরখাস্তের ফরম পূরণ করার জন্য দেন, তাহলে এ দরখাস্ত মঞ্জুর হওয়ারই পূর্ণ আশা।
এ সূরায় রাহমান ও রাহীম হিসেবে পরিচয় দিয়ে যে দোয়া শেখানো হয়েছে এ দোয়া যাতে বারবার পেশ করা হয়, সেজন্য নামাযে প্রতি রাকাআতে এ সূরাটি পড়ার হুকুম করা হয়েছে। এ হুকুমটাও আরেকটা বড় মেহেরবানী। এর মানে হলো, দরখাস্তের ফরম দেওয়া সত্ত্বেও ফরমটা পূরণ করতে যেন অবহেলা না করা হয়, সেজন্য জোর তাগিদ দেওয়া।
২. কুরআন মাজীদে এ সূরার নাম দেওয়া হয়েছে ‘উন্মুল কিতাব’ তথা কুরআনের মূল বা
সারকথা। এ সূরার মারফতে মানুষের মন-মগজ যে দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেটাই কুরআনের বুনিয়াদি শিক্ষা। যার মানসিকতা এ সূরার ভিত্তিতে তৈরি হলো, সে কুরআন মাজীদের মূল স্পিরিট পেয়ে গেল। অর্থাৎ, সূরা ফাতিহার প্রাণসত্তা যে পেল, কুরআনের দেখানো পথে চলা তার জন্যই সহজ হয়ে গেল।
‘ইসলাম’ মানে আত্মসমর্পণ— নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে তুলে দেওয়া। আর এটাই সূরা ফাতিহার সারকথা ও কুরআনের মর্মকথা।
৩. সূরা ফাতিহা সম্পর্কে হাদীসে কুদসীতে (যেসব হাদীসে কোনো কথাকে সরাসরি ‘আল্লাহ বলছেন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, ঐ হাদীসসমূহকে হাদীসে কুদসী বলা হয়।) আল্লাহ তাআলা • এমন আবেগময় ভাষায় কথা বলেছেন, যা বান্দাহর মনে গভীর দোলা না দিয়ে পারে না।
হাদীসখানা নিম্নরূপ (সূরা আল ফাতেহা)
হযরত আবূ হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসূল (স)-কে এ কথা বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ বলেন, ‘কাসামতুস্ সালাতা বাইনী ওয়া বাইনা আ’বদী নিসফাইন, ওয়া লিআ’বদী মা সাআলানী।’
অর্থাৎ আমি নামাযকে আমার ও আমার বান্দাহর মাঝে আধাআধিভাবে বিভক্ত করেছি; আর আমার বান্দাহ আমার কাছে যা চাইল, তা-ই তার জন্য রইল।
যখন বান্দাহ বলে, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’, তখন আল্লাহ বলেন, ‘হামিদানী আ’বদী’ (আমার বান্দাহ আমার প্রশংসা করল)। যখন বান্দাহ বলে, ‘আররাহমানির রাহীম’, তখন আল্লাহ বলেন, ‘আসনা আ’লাইয়া আ’বদী’ (আমার বান্দাহ আমার গুণ গাইল)। যখন বান্দাহ বলে, ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দীন’, তখন আল্লাহ বলেন, ‘মাজজাদানী আ’বদী’ (আমার বান্দাহ আমার গৌরব বর্ণনা করল)।
যখন বান্দাহ বলে, “ই-ইয়াকা না’বুদু ওয়া ই-ইয়াকা নাসতাঈন’, তখন আল্লাহ বলেন, ‘হাযা বাইনী ওয়া বাইনা আ’বদী’ ওয়া লিআ’বদী মা সাআলা’ (এটাই আমার ও আমার বান্দাহর মধ্যে সম্পর্ক আর আমার বান্দাহর জন্য তা-ই, যা সে চাইল।” অর্থাৎ, আমার ও আমার বান্দাহর মাঝে এ চুক্তি হলো যে, সে আমার কাছে চাইবে আর আমি তাকে দেব।
আর বান্দাহ যখন বলে, “ইহদিনাস্ সিরাতাল মুস্তাকীম, ওয়া লাদদোয়াল্লীন, তখন আল্লাহ বলেন, ‘হাযা লিআ’বদী ওয়া লিআ’বদী মা সাআলা (এটা আমার বান্দাহর জন্যই রইল, আর আমার বান্দাহর জন্য তা-ই, যা সে চাইল)। ”
এ হাদীসে মহব্বতের এমন অগ্নিকণা রয়েছে যে, বান্দাহর দিলে ঈমানের বারুদ থাকলে এবং নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার সময় আল্লাহর প্রাণস্পর্শী কথাগুলোর দিকে গভীর মনোযোগ দিলে আল্লাহর সাথে মহব্বতের এমন আগুন জ্বলে উঠবে যে, আবেগের গভীরতায় বান্দাহ মনিবের অতি কাছে বলে অনুভব করবে।
এ সূরা পড়ার সময় এ হাদীসটির কথা খেয়াল থাকলে একেকটি আয়াত পড়ার পর আল্লাহর প্রেমময় জবাবটা মনের কানে শোনার জন্য বান্দাহকে থামতেই হবে। এমন জবাবে যে তৃপ্তি ও শান্তি তা তারাই বোধ করতে পারে, যারা আয়াতগুলো ধীরে ধীরে মজা নিয়ে পড়ে। ৪. এ সূরাটি দুনিয়ার বাদশাহর সাথে অসহায় মানুষের গোপন কথোপকথনস্বরূপ। এখানে বাদশাহর কথাগুলো গোপনই আছে। শুধু দয়ার কাঙাল মানুষের কথাগুলোই সূরাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন— কোনো রাজার দরবারে কোনো প্রজা গিয়ে প্রথম রাজার গুণগান করে। রাজা জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কে?’ প্রজা বলে ‘আর কে, আপনারই নগণ্য খাদিম ও দয়ার ভিখারী।’ রাজা তখন জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কী চাও?’ প্রজা তখন তার আসল বাসনা জানায় । সূরা ফাতিহায় এমনই একটা ছবি ফুটে উঠেছে। বান্দাহ প্রথমে আল্লাহর গুণগান করার পর আল্লাহ যেন জিজ্ঞেস করছেন, ‘কে তুমি?’ বান্দাহ বিনয়ের সাথে জবাব দিচ্ছে, ‘একমাত্র আপনারই দাস, আপনার কাছেই সাহায্যপ্রার্থী।’
More Product >> The best 5 digital watch in 2023
আল্লাহ বলেন, ‘আচ্ছা বুঝলাম, এখন তুমি আমার কাছে কী চাও।’ বান্দাহ বলে, ‘আমাকে সঠিক পথে চালাও।’ আল্লাহ বলেন, ‘কোন্ পথটাকে তুমি ঠিক মনে কর?’ বান্দাহ বলে, ‘সে পথ আমি চিনি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, ঐ পথে চালাও, যে পথে চললে তোমার নিয়ামত সবসময় পাওয়া যাবে; কোনো সময় গযবে পড়ার কারণ ঘটবে না ও পথ হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না।’
তখন আল্লাহ বলেন, ‘যদি সত্যিই তুমি চাও যে, আমি তোমাকে সঠিক পথে চালাই তাহলে এই নাও কুরআন । এই কুরআনের কথামতো চল; তাহলে গযব থেকে বেঁচে থাকবে, ভুল পথে যাওয়ার কোনো ভয় থাকবে না এবং দুনিয়া ও আখিরাতে আমার সন্তুষ্টি ও নিয়ামত ভোগ করতে পারবে।’
৫. কুরআন মাজীদের শুরুতে এ সূরাটিকে স্থাপন করে মানবজাতিকে এ কথাই জানানো হয়েছে যে, সিরাতুল মুস্তাকীম আল্লাহর দেওয়া এমন বিরাট নিয়ামত, যা ইখলাসের সাথে মনে-প্রাণে পরম আকুতি নিয়ে আল্লাহর কাছে না চাইলে পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার সব প্রয়োজনীয় জিনিসই মানুষকে দিয়ে থাকেন। এর জন্য আল্লাহর কাছে চাওয়ার কোনো শর্ত নেই ।
আল্লাহকে অস্বীকার করলে এমনকি আল্লাহকে গালি দিলেও তিনি রিক বন্ধ করবেন না । না চাওয়া সত্ত্বেও দুনিয়ার বড় বড় নিয়ামত আল্লাহর বিদ্রোহীকেও দেওয়া হয়। কিন্তু সিরাতুল মুস্তাকীম, হেদায়াত বা আল্লাহর দীনের পথ কারো উপর চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস নয়। না চাইলে এ মহা নিয়ামত কোনো ব্যক্তি বা জাতিকে দেওয়া হয় না।
কোনো অনিচ্ছুক জাতি হেদায়াত পায় না। কারণ, হেদায়াত আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম দান এবং এ দান অপাত্রে দেওয়ার নিয়ম নেই। খাঁটি মনে কাতরভাবে মহান ও দয়াময় মনিবের নিকট ধরনা দেওয়া ছাড়া এ দান পাওয়া যায় না।
সূরা আল ফাতেহা JPG FILE