জুয়া খেলা জুয়ার সংজ্ঞা ও পরিচয়
জুয়া খেলা জুয়াকে আরবীতে ‘মায়সির’ও ‘কিমার’বলা হয়। বস্তুত মায়সির ও কিমার এমন খেলাকে বলা হয়, যা লাভ ও ক্ষতির মধ্যে আবর্তিত থাকে। অর্থাৎ যার মধ্যে লাভ বা ক্ষতি কোনটাই স্পষ্ট নয়। তাফসীরে মাআরেফুল কোরআনে উল্লেখ রয়েছে যে, যে ক্ষেত্রে কোন মালের মালিকানায় এমন সব শর্ত আরােপিত হয়, যাতে মালিক হওয়া না হওয়া উভয়েরই সম্ভাবনা থাকে। ফলে এতে লাভ কিংবা লােকসান উভয় দিকই বজায় থাকে। যেমন দুই ব্যক্তি পরস্পর একে অপরকে বাজি ধরে বলল, যদি তুমি দৌড়ে অগ্রগামী হতে পার, তাহলে তােমাকে এক হাজার টাকা দিব। আর যদি আমি অগ্রগামী হই, তবে তুমি আমাকে এক হাজার টাকা প্রদান করবে। এ ক্ষেত্রে লাভ ও লােকসান অস্পষ্ট। জুয়া খেলা
জাহিলী আমলে নানা ধরনের জুয়ার প্রচলন ছিল, বর্তমানকালে প্রাচীন পদ্ধতি ছাড়াও জুয়ার ক্ষেত্রে আরাে বহু নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন হাউজী, টাকা বাজি রেখে ঘােড় দৌড় ও তাস খেলা ইত্যাদি। এগুলাে সবই হারাম। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, শুধু নাম পরিবর্তনের কারণে বস্তুর হাকীকত (মূল প্রকৃতি) এবং হুকুম পরিবর্তন হয় না। কাজেই প্রাচীনকালে প্রচলিত জুয়া সম্পর্কে যে হুকুম প্রযােজ্য ছিল, আধুনিককালের জুয়ার ক্ষেত্রেও সে হুকুমই প্রযােজ্য হবে। শরীআতের দৃষ্টিতে জুয়া ইসলামী শরী’আতে জুয়া হারাম। জুয়া খেলা
একাধিক আয়াত ও হাদীসে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে :
پایها الذين أمنوا اما الخمر والميسر والأنصاب والأزلام رجس من عمل الشنطن فاجتنبوه لعلكم تفلحون انما يريد الشيطن أن يوقع بيتكم العداوة والبغضاء في الخمر والميسر ويصدكم عن ذكر الله وعن الصلؤة فهل انتم منتهون .
হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তােমরা তা বর্জন কর,তাহলেই তােমরা সফলকাম হতে পারবে। শয়তান তাে মদ ও জুয়াদ্বারা তােমাদের মধ্যে মধ্যে শক্রতা ও বিদ্বেষ ঘটতে চায় এবং তােমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামায আদায়ে বাধা দিতে চায়। তবে কি তােমরা নিবৃত্ত হবে না। (সূরা মায়িদা, ৫:৯০-৯১) জুয়া খেলা
এ আয়াতে মদ ও জুয়াকে ঘৃণ্য বস্তু আখ্যায়িত করা হয়েছে। এগুলােকে শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। মদ ও জুয়াকে একই পর্যায়ভুক্ত করে মুর্তিপূজার সাথে মিলিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। আয়াতে এগুলাে থেকে দূরে থাকার হুকুম করা হয়েছে। আরাে বলা হয়েছে,এতে পরস্পরের মধ্যে শক্রতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। অধিকন্তু এরষ্কারা শয়তান মানুষকে নামায আদায় করা এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ রাখে। কাজেই মদের ন্যায় জুয়াও হারাম। এর হারাম হওয়ার বিষয়টি কুরআন মাজীদের অকাট্য দলীলদ্বারা প্রমাণিত । যদি কেউ এ হুকুমকে অস্বীকার করে, তবে সে কাফির বলে গণ্য হবে।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন :
من قال لصاحبه تعال اقامر فليتصدق .
কেউ যদি তার সাথীকে বলে, এসাে, জুয়া খেলব। তাহলে এ কথার অপরাধের কারণে) সাদাকা করা তার উপর অপরিহার্য।
অতএব, জুয়াকে অর্থ উপার্জনের উপায় হিসাবে গ্রহণ করা যেমন কোন মুসলমানের জন্য জায়িয নেই, তেমনি একে খেলা, মনের সান্ত্বনা, তৃপ্তি ও অবসর বিনােদনের উপায়রূপে গ্রহণ করাও বৈধ হতে পারে না।
জুয়ার অপকারিতা
জুয়া খেলাতে বহু অপকারিতা রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি নিম্নে তুলে ধরা হলাে :
১. জুয়ার মধ্যে লাভ ও ক্ষতি উভয়বিধ সম্ভাবনা থাকে। এতে বিজয়ী ব্যক্তির কেবল লাভই লাভ। আর পরাজিত ব্যক্তির ক্ষতিই ক্ষতি। এ খেলায় পরাজিত ব্যক্তির মাল বিজয়ীর হাতে চলে যায়। এতে যে ব্যক্তি লাভবান হয়, সে পরােপকারের ব্রত থেকে দূরে সরে ক্রমেই রক্তপিপাসুতে পরিণত হয়ে পড়ে। জয়লাভকারী ব্যক্তি রাতারাতি টাকার পাহাড় গড়ে তােলে। আর পরাজিত ব্যক্তি দিন দিন সম্পদহারা হতে থাকে।
জুয়াড়ী ব্যক্তির হাতে টাকা-পয়সা না থাকলে সে সম্পদ বিক্রি করে, প্রয়ােজনে ঘরের সামানপত্র, এমনকি ঘর বিক্রি করেও এ খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। তাতেও সম্ভব না হলে চুরি-ডাকাতি করে হলেও খেলায় অংশগ্রহণের চেষ্টা করে থাকে। জুয়া খেলার সাথে চোর-ডাকাতের এবং খারাপ লােকদের সম্পৃক্ততাই সবচেয়ে বেশি। মােটকথা, এই খেলায় যেমন অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, তেমনি এতে মানুষের চারিত্রিক ক্ষতিও রয়েছে চরমভাবে।
২. জুয়ায় অভ্যস্ত ব্যক্তি ক্রমান্বয়ে উপার্জনের ব্যাপারে অলস, উদাসীন ও নিস্পৃহ হয়ে যায়। তার একমাত্র চিন্তা থাকে বসে বসে বাজির মাধ্যমে অন্যের মাল হাতিয়ে নেওয়া, যাতে কোন পরিশ্রমের প্রয়ােজন না হয়। এমনি করে অলস হয়ে তারা দেশ ও দশের উন্নয়নে আর কোন অবদান রাখতে পারে না।
আরও পড়ুন >> বাকী এবং কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয় ইসলামে জায়েজ কিনা?
৩. জুয়ার আরেকটি ক্ষতিকর দিক হচ্ছে জুয়াও মদের মত পরস্পরের মধ্যে ফাসাদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। কেননা পরাজিত ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই জয়ী ব্যক্তির প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ পােষণ করে এবং শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। জুয়ার জয়-পরাজয় এক পর্যায়ে মারামারি এমনকি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়।
৪,জুয়াড়ী ব্যক্তি জুয়ার নেশায় মদখাের ব্যক্তির ন্যায় মাতাল অবস্থায়ই থাকে সর্বদা। এ কারণে সে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও আত্মীয় কারাের খবর রাখতে পারে না। ফলে জুয়াড়ী ব্যক্তি তার, পরিবার-পরিজনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে না, ছেলেমেয়েদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত বানাতে পারে না; বরং তারাও পিতার দেখাদেখি ঐ সর্বনাশা খেলায় অংশগ্রহণের প্রয়াস পায়। এমনি করেই জুয়াড়ী ব্যক্তির পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়।
জুয়াড়ী ব্যক্তির মেজাজে সর্বদা রুক্ষতা ও নিষ্ঠুরতা বিরাজমান থাকে। লাভবান ব্যক্তি আরাে লাভের নেশায় মাতাল হয়ে উঠে। আর পরাজিত ব্যক্তি প্রতিশােধের নেশায় উন্মাদ হয়ে যায়। তাই স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের সাথে তার বিবাদ, ঝগড়া ও অশান্তি সর্বদা লেগেই থাকে। বর্তমানে স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা বা স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা, এ জাতীয় লােমহর্ষক ঘটনার পেছনে জুয়ার প্রভাবকে খাটো করে দেখা যায় না।
৫. জুয়ার সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতির দিকটি হলাে, এ খেলায় মানুষ আল্লাহ-বিমুখ এবং নামায-রােযা তথা ইবাদত-বন্দেগীর ব্যাপারে চরমভাবে উদাসীন ও গাফিল হয়ে যায়। কেননা জুয়াড়ী ব্যক্তির একমাত্র ধ্যান-ধারণা, কেমন করে আরাে টাকা হাসিল করা যায় অথবা কেমন করে পরাজয়ের প্রতিশােধ নেওয়া যায়। কাজেই জুয়ার এ সর্বনাশা গ্রাস থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য ।
লটারীও একপ্রকার জুয়া
লটারীও একপ্রকার জুয়া। কাজেই লটারীকে সাধারণ জিনিস মনে করা এবং একে জনকল্যাণমূলক কাজের নিমিত্তে জায়িয মনে করা কোনক্রমেই ঠিক নয়। যারা লটারীর ব্যবস্থাপনা করে থাকে, তাদেরকে এ সম্বন্ধে শরী’আতের বিধান শােনানাে হলে তারা বলে, এতে ক্ষতি কি? এতে তাে মানুষের বহু উপকার রয়েছে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, কোন বস্তুতে সাময়িক কিছু উপকার আছে বলেই তা হালাল হতে পারে না।
কেননা, যে বস্তুতে উপকারের চাইতে ক্ষতি বেশি, তাকে কোন অবস্থাতেই প্রকৃত উপকারী বস্তু স্বীকার করে নেওয়া যায় না। অন্যথায় পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বস্তুতেও কিছু না কিছু উপকার নিহিত থাকা মােটেও বিচিত্র নয়। প্রাণ সংহারক বিষ, সাপ-বিচ্ছু বা হিংস্র জন্তুর মধ্যেও কিছু না কিছু উপকারিতার দিক অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু সামগ্রিকতার বিচারে এগুলােকে ক্ষতিকর মনে করা হয় এবং এসব থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেওয়া হয়।
অনুরূপভাবে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে যেসব বস্তুতে উপকারের তুলনায় অপকার বেশি, শরীআত সেগুলােকেও হারাম সাবস্ত করেছে। চুরি-ডাকাতি, প্রতারণা এমন কি জিনিস আছে, যাতে উপকার কিছুই নেই। উপকার আছে বলেই এগুলােকে কেউ জায়িয মনে করে না। লটারীর বিষয়টিও ঠিক অপ। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও এতে কিছুটা উপকার আছে বলে মনে হচ্ছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে জুয়া এবং ধোকা। কাজেই শরী’আতের দৃষ্টিতে লটারীও হারাম। স্মর্তব্য, কোন মহৎ কাজের জন্য নাজায়িয তরীকা অবলম্বন করা কোনভাবেই বৈধ নয়।
বস্তুত জনকল্যাণের ধূয়া তুলে যারা এসব লটারীর ব্যবস্থা করে থাকে, মূলত জনসেবার পরিবর্তে আত্মসেবাই তাদের সামনে থাকে মূখ্য। সুন্দর চাকচিক্যময় মােড়ক লাগিয়ে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়াই তাদের লক্ষ্য। মুসলমান হিসাবে এসব প্রতারক থেকে আমাদের সাবধান হওয়া উচিত।