তাকদীরের প্রতি ঈমান আনার গুরুত্ব
তাকদীরের প্রতি ঈমান আনার গুরুত্ব – মানুষ ভবিষ্যতে যা করবে আল্লাহ্ তা’আলা যেহেতু তা আদিতেই জানেন তাই তিনি তা পূর্বেই লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। অর্থাৎ মানুষ যা করবে আল্লাহ তা’আলা তা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আল্লাহ্ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন বলে মানুষ করছে, এ কথা ঠিক নয়।
বিষয়টি বোধগম্য করার জন্য একটি উদাহরণ পেশ করা যায়। ধরা যাক, একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার তার রোগীর অবস্থা জানেন বলে তার ডায়েরীতে লিখে রাখলেন যে, এ রোগী অমুক সময় অমুক অবস্থায় মারা যাবে । অবশেষে যদি তাই হয়, এক্ষেত্রে ডাক্তারের লিখন তার মৃত্যুর কারণ নয়। ঠিক তদ্রুপ আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের অবস্থা জানেন বলে সব লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তবে এ লিপিবদ্ধকরণ মানুষের কার্যের কারণ নয়। মানুষের কার্যের কারণ মানুষের ইচ্ছা বা সংকল্প। কাজেই ভালমন্দ কাজের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী হবে।
কারো কারো মতে, তাকদীর দুই প্রকার: মুবরাম ও মু’আল্লাক
যে তাকদীরে কোন পরিবর্তন হয় না তাকে তাকদীরে মুবরাম বলে। আর যে তাকদীরে পরিবর্তন হয় তাকে তাকদীরে মু’আল্লক বলে। যেমন : ঔষধ ও দু’আর দ্বারা তাকদীর পরিবর্তন হওয়া। প্রকৃতপক্ষে তাকদীর সবই অপরিবর্তনশীল। তাকদীরের বিষয়টি কখন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এ সম্বন্ধে হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেন : আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ্ তা’আলা সৃষ্টির তাকদীর লিপিবদ্ধ করেছেন। তখন তার আরশ ছিল পানির উপর।
আরও পড়ুন>> নবীজির সহি ৩০টি হাদিস বাংলা অনুবাদ সহি দলিল সহ
তাকদীরের প্রতি ঈমান আনার গুরুত্ব – আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসের ন্যায় তাকদীরের উপর বিশ্বাস রাখাও ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ।
হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেন : কোন বান্দাই মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না এই চারটি কথায় বিশ্বাস করে—১. এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহ্র রাসূল। তিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন। ২. মৃত্যুতে বিশ্বাস করবে; ৩. মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করবে; ৪. তাকদীরে বিশ্বাস করবে।”
তাকদীরের উপর অবিশ্বাস করা মূলত আল্লাহ্ তা’আলার ইলমে আলী’ (চিরন্তন জ্ঞান)-কে অস্বীকার করারই নামান্তর। এ অবিশ্বাস মানুষকে একাধিক স্রষ্টার বিশ্বাসের দিকে নিয়ে যায়।
অন্য হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেন : আমার উম্মতের মধ্যে দুই শ্রেণীর মানুষ এমন আছে যাদের জন্য ইসলামের কোন অংশ নেই। তারা হল মুরজিয়া ও কারিয়া সম্প্রদায়।
আরও পড়ুন >> নিজাম উদ্দিন আউলিয়া জীবনী- সত্যিই কি তিনি ডাকাত ছিলেন
অপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেছেন : আমার উম্মতের মধ্যে খাস্ফ (ভূমি ধসে যাওয়া) ও মাস্খ (আকৃতি বিকৃত হওয়া) সংঘটিত হবে এবং তা তাব্দীরে অবিশ্বাসীদের মধ্যেই হবে।” তাকদীরে বিশ্বাস করা কেবল আল্লাহ্ তা’আলার ইলমে আযলী (চিরন্তন জ্ঞান)-কে স্বীকার করার প্রয়ােজনেই আবশ্যক নয়; বরং স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক স্থাপনের জন্যও তাকদীরে বিশ্বাস করা জরুরী। কেননা যারা তাকদীরে বিশ্বাসী নয় তারা হয়তো নিজেকে আল্লাহ্ তা’আলার মুখাপেক্ষী নয় বলে মনে করে অথবা আল্লাহূকে এমন পর্যায়ে মনে করে যে, তাঁকে মানা বা না মানাতে কোন ব্যবধান বা পার্থক্য নেই। বস্তুত তাকদীরকে অস্বীকার করা আল্লাহ্ তা’আলাকে অস্বীকার করারই নামান্তর।
হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেন:
আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া তারের বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। কাজেই যে ব্যক্তি ঈমান আনল কিন্তু তাকদীরকে অস্বীকার করল প্রকৃতপক্ষে সে একত্ববাদকেই প্রত্যাখ্যান করল।
তাকদীরে অবিশ্বাস এমন গুরুতর অপরাধ যে, রাহমাতুলল্লিল আলামীন (সা)-ও তাদেরকে লা’নত করেছেন। তাদীরের উপর সন্তুষ্ট থাকা ফরয। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন : “কেউ যদি আমার নির্ধারিত তাকদীরের উপর সন্তুষ্ট না থাকে এবং বিপদে ধৈর্যধারণ না করে তবে সে যেন আমি ছাড়া অন্য কাউকে রব বানিয়ে নেয়।
তাকদীর সম্বন্ধে বিভিন্ন অভিমত:
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মতে, বান্দার কর্মের স্বাধীনতা রয়েছে। সৎকর্ম করলে তাদেরকে প্রতিদান দেওয়া হবে আর অসৎকর্ম করলে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা হবে।
ইমাম আযম আবু হানীফা (র) বলেন :
মানুষকে শরী’আত পালনে দায়িত্বশীল (মুকাল্লাফ) করার বিষয়টি মাঝামাঝি ধরনের একটি বিষয়। এখানে যেমন পূর্ণাঙ্গ মাজরূরী ও বাধ্যবাধকতা নেই, তেমনি পূর্ণ ইখতিয়ার বা স্বাধীনতাও নেই। তাকদীরের প্রতি ঈমান
আরও খবর>> ব্র্যাক ব্যাংক এর এজেন্ট ব্যাংকিং এ এজেন্ট হবার নিয়ম
মানুষকে আল্লাহর পক্ষ থেকে কর্মের এমন একটি শক্তি প্রদান করা হয়েছে, যা সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু অর্জনের ক্ষমতা রাখে। মানুষের মধ্যে এই কাবের ক্ষমতা আছে বলেই ভালোর জন্য প্রতিদান এবং মন্দের জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। আবার এ ক্ষমতাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ায় মানুষকে নিজ ইচ্ছা ও কর্মের স্রষ্টা বলে অভিহিত করা যায় না। অনুরূপভাবে মানুষের মধ্যে এ শক্তি আছে বলে তাকে শক্তিহীন জড়পদার্থের মতও গণ্য করা যায় না।
হযরত শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র) বলেন, বান্দার ইখতিয়ার এবং স্বাধীনতা তো আছে তবে এ ইখতিয়ার আল্লাহ্ তা’আলার ইখতিয়ারের অধীন। অর্থাৎ কর্মের ইচ্ছা এবং কর্মের শক্তি মানুষের মধ্যে আছে কিন্তু এর সাথে আল্লাহ্র ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটলে কোন কিছুরই বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না।
মানুষ এবং মানুষের কর্ম সবই আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হয়েছে :
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহুই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমরা যা তৈরি কর তাও। (সূরা সাফাত, ৩৭ : ৯৬)।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে :
আল্লাহ্ তা’আলা সমস্ত কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুর কর্মবিধায়ক। (সুরা যুমার, ৩৯ : ৬২) তাকদীর লিপিবদ্ধ করার হিমাছ সৃষ্টির পূর্বেই তাকদীর লিপিবদ্ধ করার পিছনে বিশেষ হিকমাত নিহিত রয়েছে। তা হল, মানুষ যেন সুখ ও সফলতায় অতিশয় আনন্দিত না হয় এবং দুঃখ ও বিপদে চরমভাবে ভেঙ্গে না পড়ে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
পৃথিবীতে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয় আসে আমি তা সংঘটিত করার পূর্বেই তা লিপিবদ্ধ থাকে; আল্লাহ্র পক্ষে এটা খুবই সহজ, এটি এ জন্য যে,তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য হর্ষোৎফুল্লু না হও। আল্লাহ্ পছন্দ করেন না উদ্ধত ও অহংকারীদেরকে। (সূরা হাদীদ, ৫৭ : ২২, ২৩)
একবার এক সাহাবী প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমরা যে ঝাড়ফুক করিয়ে থাকি, চিকিৎসায় ঔষধ প্রয়োগ করে থাকি অথবা আত্মরক্ষার জন্য যে উপায় অবলম্বন করে থাকি, তা কি তাকদীরের কোন কিছুকে রদ করতে পারে?
উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : তোমাদের এ সকল চেষ্টাও তাকদীরের অন্তর্গত। তাকদীরের প্রতি ঈমান আন।
একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কুরআন শরীফে বর্ণিত হযরত ইয়াকূব (আ)-এর ঘটনার মধ্যে দেখা যায়। তিনি নিজ সন্তানদেরকে মিসর পাঠানোর প্রাক্কালে আপাতদৃষ্টিতে যে সমস্যা অনুভব করেছিলেন এর থেকে সন্তানদেরকে রক্ষা করার লক্ষ্যে তাদেরকে অসিয়াত করে বলেছিলেন :
হে আমার পুত্রগণ! তোমরা এক দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে না। ভিন্ন ভিন্ন দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে। (সূরা ইউসুফ, ১২:৬৭)
আরও পড়ুন>> সেরা ৫০ টি বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে উক্তি । Top 50 Betrayals
হযরত ইয়াকূব (আ) সন্তানদেরকে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য এ তাবীর অবলম্বন করতে বলেছিলেন। সাথে সাথে তিনি তাদেরকে তাকদীর সম্বন্ধে অবহিত করে বলেছিলেন :
আল্লাহর বিধানের বাইরে আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারি না। বিধান আল্লাহরই। আমি তার উপর নির্ভর করি এবং যারা নির্ভর করতে চায় তারা আল্লাহরই উপর নির্ভর করুক। (সূরা ইউসুফ, ১২:৬৭)
তাকদীর সম্পর্কে বিতর্ক
তাকদীরের প্রতি ঈমান আনার গুরুত্ব – তাকদীর সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। তাকদীরের উপর ঈমান রাখা আবশ্যক। এ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া নিরাপদ নয়; বরং এ বিতর্ক অনেক ক্ষেত্রে কুফরী ও নাস্তিকতা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।