আজ ২২ মার্চ দিবাগত রাত পবিত্র শবেমেরাজ। পবিত্র শবেমেরাজ এ আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে এই মহিমান্বিত রাতে তাঁর প্রিয়নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরশে আজিমে পৌঁছার ও আল্লাহতায়ালার দিদার লাভ করার পরম সৌভাগ্য অর্জন করেন।
নবুওয়াতের একাদশ বছর ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। যে বছর হযরত মুহাম্মদ সা. কে এক সম্মানজনক রাত উপহার দেয়া হয়। যা নবীদের মধ্যে শুধুমাত্র মহানবী সা.’র বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
একরাতে মহানবী সা. হাতিমে কাবায় শুয়েছিলেন। বুখারী শরীফের এক বর্ণনানুযায়ী তিনি নিজ ঘরে শুয়েছিলেন। হযরত জিবরাঈল ও মিকাঈল আ. এসে বললেন- আমাদের সাথে চলুন। বুরাক নামীয় স্পেশাল সওয়ারীর উপর আরোহণের মাধ্যমে পবিত্র এ শোভাযাত্রার সূচনা হয়।
এই বুরাকের দ্রুতগামীতার অবস্থা এই ছিল যে, যেখানে তার দৃষ্টিশক্তি পড়ছিল, সেখানেই সে পা ফেলছিল। এভাবে বিরতিহীন যাত্রার পর প্রথমে তাকে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে আল্লাহ তালা আগে থেকেই পূর্বেকার সকল আম্বিয়ায়ে কেরামকে সমবেত করে রাখেন তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়ার জন্য। এটা শুধুমাত্র বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.’র একক বৈশিষ্ট্য।
আরও পড়ুন >> ১০০/- টাকার প্রাইজবন্ড ড্র ।। Prize Bonds Result
মসজিদে আক্বসায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি এভাবে সাজানো ছিল। প্রথমে হযরত জিবরাঈল আ. আযান দিলেন এবং নামায আদায়ের জন্য সকল নবী-রাসূল কাতারবন্ধী হয়ে অপেক্ষমাণ ছিলেন যে কে নামাযের ইমামতি করবেন। হযরত জিবরাঈল আ. বিশ্বনবীর হাত ধরে ইমামতির জন্য এগিয়ে দিলেন। তিনি ইমাম হয়ে সকল নবী-রাসূল ও ফেরেস্তাদের নামায পড়ালেন। তিনি হলেন ইমামুল মুরসালিন। এ ছিল পৃথিবী জগতের ভ্রমণ যা রফরফ বুরাকের দ্বারা সম্পন্ন হয়। অতঃপর তাকে আল্লাহর নির্দেশে পর্যায়ক্রমে আসমানসমূহে ভ্রমণ করানো হয়।
প্রথম আসমানে: হযরত আদম আ.’র সাথে, দ্বিতীয় আসমানে: হযরত ঈসা আ.’র সাথে, তৃতীয় আসমানে: হযরত ইউসুফ আ.’র সাথে, চতুর্থ আসমানে: হযরত ইদ্রিস আ.’র সাথে, পঞ্চম আসমানে: হযরত হারুন আ.’র সাথে, ষষ্ঠ আসমানে: হযরত মুসা আ.’র সাথে, সপ্তম আসমানে: হযরত ইব্রাহিম আ.’র সাথে সাক্ষাত হয়। (বুখারী শরীফ, ফাতহুল বারী: পারা ১৫/পৃ.৪৮৫)
অতঃপর তিনি ‘‘সিদরাতুল মুনতাহার’’ দিকে সফর শুরু করেন। পথিমধ্যে হাউজে কাউসার অতিক্রম করেন। পরে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি খোদায়ি সব নিয়ামতের দর্শন লাভে সক্ষম হন। জান্নাতে থাকা স্পেশাল সব নেয়ামত দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন। যা কোনো চোখ আজ পর্যন্ত দেখেনি, কোনো কান শুনেনি, এবং কোনো মানুষের কল্পনা শক্তিও সে পর্যন্ত পৌঁছেনি। এরপর তাঁর সামনে হাযির করা হয় জাহান্নাম। যা ছিল সর্বপ্রকার আযাব-গযবে ভরপুর। তাতে তিনি একদল লোককে দেখলেন যারা মৃত জন্তুর গোশত খাচ্ছে। প্রশ্ন করলেন এরা কারা। উত্তরে জিবরাঈল আ. বললেন, এরা আপনার উম্মতের সেসব লোক যারা দুনিয়াতে নিজ ভাইদের গোশত খেত অর্থাৎ গীবত করত। এরপর দোযখের দরজা বন্ধ কওে দেয়া হয়।
সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত হযরত জিবরাঈল আ. ছিলেন তাঁর সফরসঙ্গী। এরপর হযরত নবীয়ে করীম সা. এহান প্রভুও সাথে একান্ত আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মাহবুবে খোদা, সরদারে দুআলম আল্লাহ তালার দর্শনে মনোনিবেশ করেন। এ দর্শন শুধু আন্তরিক ছিল না বরং চক্ষু দর্শনই ছিল।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এবং সকল সাহাবায়ে কেরাম ও ইমামগণের এ অনুসন্ধান। সেখানে মহানবী সা. এহান সৃষ্টিকর্তার কুদরতি পায়ে সেজদায় পড়ে যান। মেরাজ রজনীর এ রাতে আল্লাহ তালা উম্মতে মুহাম্মদিকে স্পেশাল গিফট হিসেবে নামায দিয়েছেন। তাই নামাযকে বলা হয় মুমিনের মেরাজ। প্রভাতের আগেই কল্যাণময় এ সফরের সমাপ্তি ঘটে।
শবে মেরাজে বিশেষ আয়োজন করা বিদআত : রজবের ২৭ তারিখ রজনীতে বিশেষ কোনো আয়োজন করা বিদআত। তবে সাধারণত: প্রত্যেক রাতে যেসব ইবাদত করা হয়, শবে মেরাজের রাতে সেসব ইবাদত করাতে কোনো বাধা নেই। অর্থাৎ গতরাতে যেভাবে জেগে ইবাদত করেছিলেন আজ শবে মেরাজের রাতেও সেভাবে করুন। এতে কোনো প্রকার পার্থক্য বুঝা যায়না।
২৭ রজবে রোযা রাখার কোনো দলিল নেই : এ দিনটিতে রোযা রাখাকে কেউ কেউ আশুরা ও আরাফার দিনের রোযার ন্যায় ফযিলত সম্পন্ন মনে করে থাকেন। মূলত: এ তারিখে রোযার স্বপক্ষে দুয়েকটি দুর্বল রেওয়ায়ত ব্যতিত কোনো বিশুদ্ধ সনদের সাথে এর পক্ষে কোনো দলিল নেই।
হযরত ফারুক্বে আযম চিরতরে বন্ধ করলেন বিদআতের এ পন্থা : ২য় খলিফা হযরত ওমর রা. এর খেলাফতকালে কেউ কেউ এ তারিখে রোযা রাখা শুরু করল। রোযা রাখার সংবাদ যখনই খলিফা জানতে পারলেন ঠিক তখনই তিনি বের হয়ে তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা সবাই আমার সামনে খানা খাও এবং প্রমাণ করে দাও যে তোমাদের রোযা নাই’।
আরও পড়ুন >> সূরা ইখলাস ও সূরা কাহাফ পাঠের ফজিলতসমুহ
তিনি সামনে থেকে তাদেরকে খানা পরিবেশন করালেন এজন্য যে, তাদের অন্তরে এ বিশ্বাস জন্মে যে, আজকের রোযা ও নফল রোযার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ দিনটিতে রোযা রাখার আলাদা ফযিলত মনে করে রাখলে তা হবে বিদআতের পর্যায়ভুক্ত। হযরত ওমর রা. এ পদক্ষেপটি এ জন্য নেন যাতে বিদআতের এ পথটি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এবং নিজের পক্ষ থেকে কোনো প্রকারের সীমাতিরিক্ত কাজ না হয়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, হাল যামানার মুসলমানরা ফরয রোযার মতই এ দিনটির রোযাকে গুরুত্ব সহকারে রাখে। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সহিহ সমুঝ দান করুন।
উক্ত রাতে জেগে থেকে কি পাপ করেছি: আমাদের সমাজে ইসলামপ্রিয় অনেক লোক এমনও আছেন যারা উপরোক্ত বিষয় উপলব্ধি করার পরও বলেন যে, আমরা শবে মেরাজে ইবাদত করে ও রোযা রেখে কি পাপ করেছি? আমরা মদ পান করেছি নাকি ডাকাতি করেছি? আমরা তো এ রাতে ইবাদতই করেছি। হযরত ফারুক্বে আযমের কাজ দ্বারা এ সকল ব্যক্তিদের এ শিক্ষা দিয়েছেন যে, ‘‘মেরাজের রাতে বিশেষভাবে ইবাদত করা ও দিনে রোযা রাখায় এ পাপ হয়েছে যে, আল্লাহ পাক সেদিন কোনো বিশেষ রোযা রাখার নির্দেশ দেননি। আর শবে মেরাজ উদযাপন করতেও বলেননি। (আর-রশিদ)
আল্লাহর হুকুম পালনই পুরো দ্বীনের সারাংশ: পুরো দ্বীনের সারাংশ মহান আল্লাহ তাআলার পবিত্র এ বাণী-‘তোমরা আল্লাহর হুকুম মানো’। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যখন যে ইবাদতের হুকুম করেছেন, তখন তা আদায় করাই হল আল্লাহর হুকুম পালন করা। আল্লাহ তাআলা যদি দয়া ও অনুগ্রহ করে এ বাস্তবতাকে আমাদের অন্তরে ঢেলে দেন তখনই এসকল বিদআতের মূলোৎপাটন হওয়া সম্ভব।
মাহে রজব রমজানের ভূমিকা, তাই রমজান আসার আগেই প্রত্যেকে সিয়াম-সাধনার প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। এ জন্যই মহানবী সা. রজব মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এই দুআ করতেন-‘‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবা ওয়া শা’বান, ওয়া বাল্লিগনা রামাযান’’ অর্থাৎ হে আমার প্রভু! আপনি আমাকে রজব-শা’বানে বরকত দান করুন। এবং এ বরকত সাথে নিয়ে রমযান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।
পরিশেষে, আমি মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের সবাইকে যাবতীয় বিদআত থেকে দূরে রাখেন এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সঠিকভাবে ইবাদত করার তৌফিক দান করেন। আমিন।