ট্যাং ফলের গুনাগুন ও চাষ পদ্ধতি এবং বর্তমান বাজার

Spread the love

ট্যাং ফলে গুনাগুন

এই ফলের গুনাগুন ও চাষ পদ্ধতি – ট্যাং বা প্যাশন ফল ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ একটি ফল। বাংলাদেশে এটি একটি অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। প্যাশন ফল বহুবর্ষজীবী লতা জাতীয় উদ্ভিদ। অনেকের কাছে এটি ট্যাং ফল নামে পরিচিত। এটি Passifloraceae গোত্রের ফল যার ইংরেজি নাম Passion fruit এবং বৈজ্ঞানিক নাম Passiflora edulis.

ফলের বৈশিষ্ট্যঃ

পার্পল প্যাশন ফল এবং হলুদ প্যাশন ফল প্যাশন ফল হতে প্রাকৃতিক মিউটেশনের মাধ্যমে হলুদ প্যাশন ফল উৎপত্তি হয়েছে যা আকারে ও গুনাগুনে মাতৃত্ব পার্পল প্যাশন ফল হতে উন্নত। পাঁচটি পাপড়ি সমৃদ্ধ প্যাশন ফলের ফুল অত্যান্ত আকর্ষনীয়, মনোমুগ্ধকর, ও সুগন্ধিযুক্ত।

দেখতে অনেকটা ঝুমকো লতার ফুলের মতো। ফলের ভিতর গাত্রে অসংখ্য হলুদাভ, রসপূর্ণ থলে থাকে, এগুলি ভক্ষণযোগ্য অংশ। টাটকা ফল হিসেবে খাওয়ার চেয়ে প্যাশন ফলের তৈরি শরবত বেশি উপাদেয়।

চাষের সম্ভাবনাময় এলাকাঃ

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চল, সিলেট, টাঙ্গাইল এবং রাজশাহী অঞ্চলে ইহা কম বেশি দেখা যায়। তবে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আদিবাসীদের বসতবাড়িতে সল্পপরিসরে অযত্নে ও অবহেলায় ফলটির আবাদ লক্ষ্য করা যায়। ঝুমকো লতার সমগোত্রীয় প্যাশন ফলের গাছ দীর্ঘ প্রসারী এবং বহুবর্ষজীবী। বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকায় সিলেট ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে এবং নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলায় প্যাশন ফল চাষে অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্যাশন ফল থেকে উৎপাদিত খাদ্যসমূহ:

উক্ত ফলের বীজকে আবৃত করে থাকা হলুদ, জিলাটিনাস, সুগন্ধিযুক্ত পাল্পকে পানিতে দ্রবীভূত করে খুবই উপাদেয় শরবৎ প্রস্তত করা যায়। এটিকে অন্যান্য জুসের সাথেও মিশ্রিত করে খাওয়া যায়। পাল্পকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে আইসক্রীম, জুস, স্কোয়াশ, জ্যাম ও জেলি প্রস্তত করা যায়। বীজ ও খোসা হতে পেকটিন ও উচ্চ মাত্রার লিনোলিক এসিড সমৃদ্ধ তেল আহরণ করা সম্ভব।

প্যাশন ফলের জাতঃ

বারি প্যাশন ফল-১ এর আকার ৬.৮ সেমি x ৬.৩ সেমি। ফসলের গড় ওজন ৬৮ গ্রাম এবং ৩০ গ্রাম জুস আহরন করা যায়। জুসের রং হলুদ এবং টিএসএস (%) মান ১৪। এ জাতটি ফিউজেরিয়াম উইল্ট এবং নেমাটোড প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন।

মাটি ও জলবায়ুঃ

ট্যাং ফল চাষের জন্য অত্যাধিক তাপ ও ঠান্ডামুক্ত মৃদু জলবায়ু প্রয়োজন। উপযুক্ত তাপমাত্রা হচ্ছে ১৮-৩২ ডিগ্রি সে. । ৫.৫-৭.৫ pH যুক্ত উর্বর, সুনিষ্কাশিত দোঁআশ মাটি উত্তম। এ ফল জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। মাটিতে উঁচু বেড তৈরি করে চাষ করা ভালো। তবে pH ৫.৫ এর নীচে হলে চুন প্রয়োগ করে মাটির উপযুক্ততা তৈরি করে এ ফলের চাষ করা ভালো।

বংশ বিস্তারঃ

ক) বীজ দ্বারাঃ ফলের পাল্প থেকে বীজ আলাদা করে পানি দ্বারা ধৌত করে ছায়ায় শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। এ বীজ সরাসরি বীজতলায় অথবা পলিব্যাগে বপন করে চারা তৈরি করা যায়। বীজতলায় ৮-১২ সেমি. দূরে ১-২ সে.মি গভীরে বীজ বপন করে খড় দ্বারা মালচ দিতে হয়। ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে বীজ অংঙ্কুরিত হয়।

চারা ২-৪টি পাতা সম্পন্ন হলে বীজ তলা থেকে তা তুলে পলিব্যাগে স্থানান্তর করা যায়। চারার বয়স ৩-৫ মাস হলে চারা ৩০-৪০ সেমি. লম্বা হলে রোপণের উপযু্ক্ত হয়। তবে মনে রাখতে হবে, সংরক্ষিত বীজের সজীবতা থাকে মাত্র ৩-৫ সপ্তাহ।

খ) কাটিং দ্বারাঃ ৩-৪ টি পর্ব বিশিষ্ট শাখা কেটে বংশবিস্তার করা যায়। কাটিং করার সময় শাখার নীচের পর্ব হতে ১-২ সেমি. নীচে তেরেসা করে কাট দিয়ে নীচের পর্বসহ বীজ তলার মাটিতে ৪৫ ডিগ্রী কোন করে উত্তর-দক্ষিণ দিকে মুখ করে মাটিতে রোপণ করতে হবে।

কাটিং রোপণের সময় উপরের অংশে ১-২ টি পাতা রেখে বাকি পাতা ফেলে দিতে হবে। ৩৫-৫০ দিন বয়সের মধ্যে কাটিং এর সফলতা লক্ষ্য করা যায়। ৩-৫ মাস বয়সের চারা রোপণের উপযুক্ত হয়। কাটিং করার উপযুক্ত সময় মে-আগষ্ট। কাটিং এর চারায় মাতৃ গুনাগুন বজায় রাখে।

গ) গ্রাফটিং ট্যাং ফলের গুনাগুন ও চাষ পদ্ধতি – বর্তমানে প্যাশন ফলে কেফট গ্রাফটিং এর মাধ্যমেও বংশবিস্তার করা যায়। তবে কাটিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করা সহজ। কাটিং ও গ্রাফটিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করলে মাতৃ গুনাগুন বজায় থাকে। তবে টিস্যু কালচারের মাধ্যমেও প্যাশন ফলের বংশবিস্তার করা সম্ভব।

চারা রোপণ ও সার ব্যবস্থাপনাঃ

উপযুক্ত সময় হচ্ছে মে-আগষ্ট। ট্যাং ফলের গুনাগুন ও চাষ পদ্ধতি – ২-৪ মি. x ২.৫-৫.০ মি. দূরত্বে এ ফলের চারা রোপণ করা হয়। রোপণের জন্য ৫০ x ৫০ x ৫০ সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করে প্রতি গর্তে ২০-২৫ কেজি পঁচা গোবর, ২০০-৩০০ ইউরিয়া ও টিএসপি এবং ৪০০-৫০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করা হয়।

চারা রোপণের পর মাটিতে উপযুক্ত আর্দ্রতা রাখার জন্য সেচ দিতে হবে। তবে ভালো ফলনের জন্য ফুল আসা ও ফলের বিকাশের সময় মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকা দরকার। ফলে খরা মৌসুমেও সেচ প্রদান করা প্রয়োজন। তবে বর্ষাকালে যেন গাছের গোড়ায় পানি জমতে না পারে সেজন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

আন্তঃপরিচর্যাঃ

বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য মাচা তৈরি করা হয়ে থাকে। চারার গোড়ায় খুঁটি পুঁতে গাছ উঠিয়ে দেওয়া হয়। গাছ মাটির উপর উঠলে গাছের অগ্রভাগ কেটে দেওয়া হয় যাতে শাখা বের হয় এবং সমস্ত মাচা ছড়িয়ে পড়ে। মাটি থেকে মাচা পর্যন্ত গাছের কাণ্ডে কোন শাখা বের হলে তা কেটে দেওয়া হয়। বাড়ির আশে পাশে মাচা তৈরি করে বা বড় ফলের গাছে বা সবজির বেড়ায় উঠিয়ে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় সব সময় আগাছা দমন করতে হবে। তবে প্যাশন ফলের বাগানে ইদুরের উপদ্রব বেশি দেখা দিলে তা দমন করতে হবে।

ডাল ছাঁটাইকরণঃ

এই অনুচ্ছেদে, ট্যাং ফলের গুনাগুন গাছের গোড়া থেকে ১.৫- ২.০ মিটার পর্যস্ত কোন ডালপালা রাখা যায় না। তাই এ সমস্ত ডালা সব সময় কেটে দেওয়া ভালো। যেহেতু নতুন শাখায় বেশি ফুল ও ফল উৎপন্ন হয় তাই প্রতি বছর নিয়মিত কিছু শাখা প্রশাখা কেটে দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে পুরাতন ও মরা ডাল কেটে দিতে হয়। এতে রোগ বালাই কম হবে। শীতকালই ডাল ছাঁটাইকরণের উপযুক্ত সময়।

ফলের পরিপক্কতাঃ

সর্বপরি, ট্যাং ফলের গুনাগুন ও চাষ পদ্ধতি – ট্যাং বা প্যাশন ফলে বছরে দুইবার ফল পাওয়া যায়। প্রথমত, মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল আসে এবং জুন-আগষ্ট মাসে ফল পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, জুলাই-আগষ্ট মাসে ফুল আসে এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফল পাওয়া যায়। পরিশেষে, গাছ লাগানোর ১৪-২০ মাসের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়। প্যাশন ফুল পর-পরাগী, ফুল দুপুরে উন্মুক্ত হয় এবং সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়।

Check Also

তেঁতুলের উপকারিতা ও অপকারিতা

জেনে নেই তেঁতুলের উপকারিতা ও অপকারিতা

Spread the loveতেঁতুলের উপকারিতা ও অপকারিতা – তেঁতুলের কথা বললেই মুখে জল চলে আসে। সত্যিই …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *