আল কুরআন মহান আল্লাহর মর্যাদাপূর্ণ বাণী সমষ্টির এক অবিস্মরণীয় ও বিস্ময়কর গ্রন্থ। আল কুরআন এমন এক গ্রন্থ তা পাঠ করলে প্রতিটি অক্ষরে একটি করে সওয়াব লেখা হয় যা দশটির সমান। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে তার একটি সওয়াব হবে। আর একটি সওয়াব দশটি নেকির অনুরূপ। আমি বলি না যে, “আলিফ-লাম-মীম” একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, এবং মীম আরেকটি হরফ। (অর্থাৎ এতে রয়েছে তিনটি সওয়াব যা ত্রিশটি সওয়াবের সমান)।” [সুনান তিরমিজী, হা/২৯১০, অনুচ্ছেদ: যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পড়বে তার সাওয়াব কী হবে? অধ্যায়: ৪৮/ কুরআনের ফযিলত -সনদ সহিহ]
সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করবে সে উক্ত সওয়াব লাভ করবে ইনশাআল্লাহ- চাই বুঝে পড়ুন অথবা না বুঝে পড়ুক, দেখে পড়ুক অথবা মুখস্থ পড়ুক, মুসহাফ দেখে পড়ুক অথবা মোবাইল, ল্যাপটপ ইত্যাদি ডিভাইস থেকে পড়ুক, নামাজের মধ্যে পড়ুক অথবা নামাজের বাইরে পড়ুক। কিন্তু তিলাওয়াত শোনার মধ্যেও রয়েছে অসীম কল্যাণ ও অতুলনীয় উপকারিতা।
কুরআন শ্রবণের ৮টি অনবদ্য উপকারিতা গুলোঃ
● ১. আল্লাহর রহমত ও অনুকম্পা লাভ।
● ২. হেদায়েত (সঠিক পথের নির্দেশনা) লাভ।
● ৩. ঈমান বৃদ্ধি।
● ৪. সত্যকে চেনার উপলব্ধি সৃষ্টি।
● ৫. জ্ঞানার্জন।
● ৬. আল্লাহর সহজ ইবাদত।
● ৭. কুরআন তিলাওয়াত শোনা সুন্নত।
● ৮. মনে অনাবিল প্রশান্তি ও স্বস্তি লাভ।
কুরআন তিলাওয়াত শোনার মর্যাদার বিষয়গুলো সংক্ষেপে দলিল সহ উপস্থাপন করা হল:
## ১. আল্লাহর রহমত ও অনুকম্পা লাভ:
মনোযোগ সহকারে কুরআন তিলাওয়াত শুনলে আল্লাহর রহমত ও অনুকম্পা লাভ হয়। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো এবং নীরবতা অবলম্বন করো যাতে তোমরা রহমত প্রাপ্ত হও।” (সূরা আরাফ: ২০৪)
তাফসিরে ত্ববারীতে এসেছে: আবু জাফর বলেন: মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করার অর্থ হল:
“তোমরা কান লাগিয়ে শোনো যেন আয়াতের অর্থ বুঝতে পারো এবং উপদেশ বার্তাগুলো থেকে উপদেশ গ্রহণ করো।” (তাফসিরে ত্ববারী)
ইবনে কাসির রাহ. বলেন:
“আল্লাহ তাআলা কুরআন তিলাওয়াতের সময় নীরবতা অবলম্বন করার আদেশ করেছেন তার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনার্থে।” (তাফসিরে ইবনে কাসির)
## ২. হেদায়েত (সঠিক পথের নির্দেশনা) লাভ:
মনোযোগ সহকারে কুরআন তিলাওয়াত শোনার পাশাপাশি তার অনুসরণ করলে আল্লাহ তাআলা হেদায়েত (সুপথ) দেখান। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যারা মনোনিবেশ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে। তাদেরকেই আল্লাহ সুপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান।” (সূরা যুমার: ১৮)
– আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
“জিনদের একটি দল কুরআন শ্রবণ করেছে, অতঃপর তারা বলেছে: আমরা বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি; যা সুপথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি।” (সূরা জিন: ১ -২)
– তিনি আরও বলেন,
“যখন আমি একদল জিনকে আপনার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম, তারা মনোযোগ সহকারে কুরআন পাঠ শুনছিল। তারা যখন কুরআন পাঠের জায়গায় উপস্থিত হল, তখন পরস্পর বলল, চুপ থাক। অতঃপর যখন পাঠ সমাপ্ত হল, তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে সতর্ক কারী রূপে ফিরে গেল।” (সূরা আহকাফ: ২৯ ও ৩০)
সুতরাং যে ব্যক্তি মনোযোগ সহকারে কুরআন তিলাওয়াত শুনবে তার জীবন আল্লাহ দয়া ও অনুকম্পায় সিক্ত হওয়ার পাশাপাশি লাভ করবে হেদায়েত তথা সঠিক দিকনির্দেশনা। সে কুরআনে মধ্যে খুঁজে পাবে তার ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, নানা প্রশ্নের উত্তর, ব্যক্তি ও চারিত্রিক উন্নয়ন, মানসিক প্রশান্তি ও আনন্দ মুখর জীবনের রূপরেখা, পারিবারিক সুখ, সামাজিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও পরিচ্ছন্নতা, আত্মিক পরিশুদ্ধতা, রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সর্বোত্তম নীতি এবং সর্বোপরি আল্লাহর ইবাদতে সুগভীর পরিতৃপ্তি।
তবে আমাদের ভাষা যেহেতু আরবি নয় সেহেতু কুরআন থেকে যথার্থভাবে হিদায়ত অর্জন করতে চাইলে তরজমা ও তাফসির শোনা অধিক উত্তম তাতে কোন সন্দেহ নাই।
## ৩. ঈমান বৃদ্ধি:
তিলাওয়াত শ্রবণ করার মাধ্যমে অন্তরে ঈমান বৃদ্ধি পায়। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আর যখন তাদের সামনে (কুরআন) তিলাওয়াত করা হয় হয়, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়।” (সূরা আনফাল: ২)
## ৪. সত্যকে চেনার উপলব্ধি সৃষ্টি:
গভীর মনোযোগ সহকারে কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করার পাশাপাশি তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার ফলে অন্তরে আল্লাহ ভীতি সৃষ্টি হয় এবং সত্য উপলব্ধির অন্তর চক্ষু উন্মোচিত হয়। ফলে এই উপলব্ধি থেকে দুচোখ বেয়ে অশ্রু বিগলিত হয়। যেমন: আল্লাহ তা’আলা সাহাবীদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেন,
“আর তারা রসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন শুনে তখন আপনি তাদের চোখ অশ্রু সজল দেখতে পাবেন; এ কারণে যে, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে।” (সূরা মায়িদা: ৮৩)
## ৫. জ্ঞানার্জন:
যে কোন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের চাবিকাঠি হল, মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা। সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রহ. বলেন:
“জ্ঞানের প্রথম ধাপ হল, মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা। তারপর বুঝা, তারপর মুখস্থ করা, তারপর কর্মে বাস্তবায়ন করা, তারপর প্রচার ও প্রসার করা। সুতরাং বান্দা যখন আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের রসূলের আল্লাহর পছন্দ মত সৎ নিয়তে মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে আল্লাহ তাকে তা বোঝার ক্ষমতা দান করেন যেভাবে তিনি পছন্দ করেন এবং তার অন্তরে আলো ঢেলে দেন।” (তাফসিরে কুরতুবী ১১/১৭৬)
সুতরাং মনোযোগ দিয়ে শুনার মাধ্যমে হ্রদয়ে অনেক অজানা তথ্যের উন্মেষ ঘটে, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বোধশক্তির উন্নতি সাধিত হয় এবং বিচক্ষণতা বৃদ্ধি পায়। এভাবে মানুষ নানাভাবে উপকৃত হয়। তাই তো আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
“এতে (কুরআনে) উপদেশ রয়েছে তার জন্যে, যার অনুধাবন করার মত অন্তর রয়েছে অথবা যে নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে।” (সূরা ক্বাফ: ৩৭)
আরও পড়ুন >> সূরা ইখলাস ও সূরা কাহাফ পাঠের ফজিলতসমুহ
## ৬. সহজ ইবাদত:
কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করা একটা ইবাদত। কারণ তিনি আমাদেরকে কুরআন শোনার নির্দেশ দিয়েছেন। (যেমনটি উপরোক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদিস সমূহ)। সুতরাং শুনার মাধ্যমেও আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে এবং অর্জিত হবে অবারিত সওয়াব।
(যদি তিলাওয়াত শুনলে তিলাওয়াত করার সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যাবে কি না সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন হাদিস পাওয়া যায় না।)
আর এটি এত সহজ ইবাদত যে, আমরা বাড়িতে, গাড়িতে, অফিসে, দোকানে, রাস্তায় চলতে চলতে, দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে যে কোন অবস্থায় খুব সহজে তা করতে পারি। বর্তমানে আধুনিক টেকনোলোজি, অডিও, মেমরি আর স্মার্ট ফোনের যুগে তা আরও সহজ হয়ে গেছে আল হামদুলিল্লাহ।
##৭. কুরআন তিলাওয়াত শোনা সুন্নত:
হাদিসে এসেছে:
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, “আমাকে তুমি তিলাওয়াত করে শুনাও।”
আমি বললাম: আমি আপনাকে তিলাওয়াত শোনাব অথচ আপনার ওপরই এটি অবতীর্ণ হয়েছে?
তিনি বললেন: “আমি অন্যের তিলাওয়াত শুনতে পছন্দ করি।”
অতঃপর আমি তাঁকে সূরা নিসা পড়ে শুনাতে লাগলাম।“অতএব কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকে উপস্থিত করব তাদের উপর সাক্ষী রূপে? ”(সূরা নিসা: ৪১) পর্যন্ত পৌঁছলাম তিনি বললেন: “ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে।”
তখন আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে।” [সহিহ বুখারী : ৫০৫০ ও মুসলিম : ১৯০৩]
## ৮. মনে অনাবিল প্রশান্তি ও স্বস্তি লাভ:
কুরআন নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা, পরস্পরে অধ্যয়ন, তিলাওয়াত করা ও শুনা ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর দয়ায় সিক্ত হওয়ার পাশাপাশি হৃদয়ে নেমে আসে অনাবিল প্রশান্তি ও অভূতপূর্ব স্বস্তির সুবাতাস। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
আবু হুরায়রা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: “যখন কিছু লোক আল্লাহর কোন এক ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন পাঠ করে এবং একে অপরের সাথে কুরআন নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও অধ্যয়ন করে তখন তাদের উপর শান্তি বর্ষিত হয়, আল্লাহর রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে, ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তাআলা ঐ সমস্ত বান্দাদেরকে তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের সামনে উল্লেখ করেন।” [সুনানে আবু দাউদ, হা/১৪৫৫ অধ্যায়ঃ ২/ সালাত, পরিচ্ছদ: ৩৫৫. কুরআন তিলাওয়াতের সাওয়াব সম্পর্কে (ইফা)]
মোটকথা, কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণের মধ্যে সওয়াব অর্জনের পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন দিক দিয়ে উপকার লাভ করতে পারি। শোনার মাধ্যম যাই হোক না কেন। কেউ যদি ক্বারি সাহেবের সরাসরি তিলাওয়াত শুনে অথবা তার ধারণকৃত তিলাওয়াত ইউটিউব, মোবাইল মেমরী, সিডি, ল্যাপটপ ইত্যাদিতে থেকে মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করে তাহলে তার জীবন আল্লাহর সর্ববৃহৎ নিয়ামত হিদায়েত বা সুপথ প্রাপ্তি এবং তাঁর অসীম দয়া ও অনুকম্পার শীতল বারি বর্ষণে জীবন হয়ে উঠবে ফুল-ফলে সুশোভিত ও সঞ্জীবিত। মনের মধ্যে অর্জিত হবে অনাবিল জান্নাতি সুখ ও প্রশান্তি এবং দূর হবে সকল অন্ধকার, হতাশা, অস্থিরতা, কষ্ট এবং দু:শ্চিন্তা।
“হে আল্লাহ, কুরআনকে তুমি আমার হৃদয়ের প্রশান্তি, আমার বক্ষের জ্যোতি,আমার চিন্তা-ভাবনার অপসারণকারী এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিদূরীত কারীতে পরিণত করো।” আমিন।
▬▬▬ ◈❥◈▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব